যে জাতি আপন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞ সে জাতি নিঃসন্দেহে হতভাগ্য। কেননা ইতিহাস শুধু অতীতের ফেলে আসা হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার ঘটনাই প্রকাশ করে না; সাথে সাথে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ চলার পথের প্রেরণার উৎস ও সঠিক দিশা দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশী নামক স্থানে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাই পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় হলো এই ‘পলাশী যুদ্ধ’। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গøানিকর এবং কলঙ্কিত ঐতিহাসিক দিন ২৩ জুন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ নামের যে মর্মস্পর্শী নাটক অভিনীত হয়েছিল তাতে সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় কেবল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবেরই পতন হয়নি, অবসান হয় বাংলার স্বাধীনতার। তার পরাজয় ও নির্মম হত্যার পরিণতিতে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়। এরপর ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে দুইশত বছর আধিপত্য বিস্তার করেছে। পলাশীর যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে কোনো যুদ্ধই ছিল না, ছিল ষড়যন্ত্রমূলক একটা যুদ্ধের অভিনয় মাত্র। একটা পাতানো যুদ্ধের ছলনা, একটা প্রহসন। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের কথায় : “বিশ্বাসঘাতকতার জন্য পলাশীতে যে ইংরেজরা জয় লাভ করিয়াছিল, ইহা নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক মাত্রেই এক মত। একজন ইংরেজ লেখকের উক্তি- Truth will ascribe the achievement to treachery. ঐতিহাসিকরা বলেছেন, পলাশীর যুদ্ধ সত্যিকারার্থে কোনো যুদ্ধ ছিল না, এটা ছিল একটা গভীর ষড়যন্ত্র। প্রায় বিনা যুদ্ধেই নবাবের পতন হয়েছে। বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ একটি বিখ্যাত যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাই কেউ কেউ বলেন, এটি যুদ্ধ ছিল না, ছিল ষড়যন্ত্রের কালো থাবা।
১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খান মৃত্যুবরণ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হলেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেই দেখলেন সিংহাসনকে ঘিরে নানা কুটিল চক্রান্তের জাল। সেনাপতি মীর জাফর, রাজবল্লভ, উমিচর্ঁাদ, দুহাজারী মসনদদার ইয়ার লতিফ, দেশের ব্যাংকারে পরিণত জগৎশেঠ প্রমুখ প্রভাবশালী নানা ষড়যন্ত্রে ও চক্রান্তে লিপ্ত। এর মধ্যে ইংরেজদের সাথে এই স্বার্থ-সন্ধানী চক্রান্তকারীদের যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে ঘষেটি বেগমের অন্ধ আক্রোশ ও প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। মূলত ১৭০৭ সালে স¤্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে মোগল শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। দিল্লি ছিল শাসনের মূল কেন্দ্র। কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ শিথিল ও দুর্বল হওয়ার সুযোগে সারা ভারতে হিন্দু, খ্রিস্টান, মারাঠা শক্তি প্রবল হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে প্রধান হুমকি হয়ে দেখা দেয় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আগত ইংরেজ বণিকরা। ভাগ্যান্বেষী ইংরেজরা তৎকালীন মোগল স¤্রাট আজিম-উশ-শানের আমলে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে হুগলি নদীর তীরবর্তী সুতানটি গ্রামটি ক্রয় করে। পরে এর সাথে যোগ হয় কলকাতা ও গোবিন্দপুর গ্রাম। এভাবেই বাংলাদেশের বুকে প্রথমে ইংরেজদের প্রবেশাধিকার সূচিত হয়। ইংরেজরা এখানে দুর্গ গড়ে তোলে।
পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আজ্ঞাবহ ঐতিহাসিক ও ইংরেজ ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে নানাভাবে বিকৃত ও সিরাজ চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার বিচারে এবং ইতিহাসের অনুসন্ধানে এসবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সত্য সন্ধানী ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্র কঠোর পরিশ্রম ও গবেষণা করে তার ‘সিরাজউদ্দৌলা’ গ্রন্থে এসব দোষের ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করেছেন।
হিন্দু জমিদার ও প্রধানগণ সিরাজ-উদ-দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। তাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য রাজা মহেন্দ্র, রাজা রামনারায়ণ, রাজা কৃষ্ণদাস, রাজা রাজবল্লভ, মীর জাফর প্রমুখ প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গ মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাড়িতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মন্ত্রণায় মিলিত হন। জানা যায় এ লক্ষ্যে বেশ কয়টি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব সভার আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ইংরেজদের সাহায্য নেয়া হবে এবং পরবর্তী সময়ে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কলকাতায় গিয়ে ইংরেজ সেনাপতি কর্নেল ক্লাইভের সাথে সাক্ষাৎ করে পরিকল্পনা ঠিক করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাইভ মীর জাফরের সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করেন, চুক্তি অনুসারে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে অপসারণ করে তার জায়গায় মীর জাফরকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসানোর প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়। এ চক্রান্তের সাক্ষী ছিলেন জগৎশেঠের প্রতিনিধি ধনকুবের উমির্চাঁদ।
মীর জাফরের সঙ্গে ইংরেজরা যে গুপ্ত সন্ধি প্রণয়ন করেছিলেন ১৭ মে কলকাতা ইংরেজ দরবারের সে সন্ধিপত্রের খসড়া আলোচিত হয়, এই সন্ধিপত্রে সিরাজ-উদ-দৌলাকে অপসারণের মূল্য স্বরূপ কোম্পানি বাহাদুর এক কোটি টাকা, কলকাতাবাসী ইংরেজ, বাঙালি ও আরমানিগণ সত্তর লক্ষ টাকা এবং উমিচর্ঁাদের জন্য ত্রিশ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
১৭৫৭ খিস্টাব্দের ১২ জুন কলকাতা ও চন্দননগরে ইংরেজ সেনা একত্রিত হয় এবং ১৩ জুন ব্রিটিশ বাহিনী যুদ্ধযাত্রা করে। গোলাবারুদ নিয়ে গোরারা দুইশত নৌকায় যাত্রা করে আর কালো আদমিরা গঙ্গাতীরের বাদশাহি রাস্তা বরাবর অগ্রসর হতে থাকে। পথে হুগলি ও কাঠোয়ার দুর্গে হুগলিতে নবাব সেনারা ইংরেজদের পথ রোধ করেনি, মুর্শিদাবাদের গুপ্তমন্ত্রণা হুগলির ফৌজদারকে কর্তব্যভ্রষ্ট করেছিল। সিরাজ-উদ-দৌলা ঐ পরিস্থিতিতে মীর জাফরকে বন্দি করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তাকে রাজ সদনে আহŸান করেন। সিরাজ-উদ-দৌলা ভেবেছিলেন, ইসলামের নামে, আলীবর্দীর নামে, স্বাধীনতার নামে মীর জাফরের বিভ্রান্তি দূর করবেন। তিনি মীর জাফরকে ক্ষমা প্রদর্শন করে, আল্লাহর নামে, মোহাম্মদ সা:-এর নামে, ইসলামের গৌরবের নামে, নবাব আলীবর্দীর বংশ মর্যাদার দোহাই দিয়ে মীর জাফরকে ফিরিঙ্গি সংসর্গ ত্যাগ করে তার সঙ্গে আসার জন্য উদাত্ত আহবান জানান। আবার কুরআন শরীফ আনা হয়, এবার পরম পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফ মাথায় নিয়ে অন্নদাতা মুসলমান নবাবের কাছে মুসলমান সেনাপতি জানুপেতে শপথ করেন আল্লাহর নামে। “পয়গম্বরের নামে ধর্মশপথ করিয়া অঙ্গীকার করিতেছি, যাবজ্জীবন মুসলমান সিংহাসন রক্ষা করিব, প্রাণ থাকিতে বিধর্মী ফিরিঙ্গির সহায়তা করিব না। এভাবে মীর জাফর সিরাজ-উদ-দৌলার সন্দেহ দূর করে তাকে প্রতারণা করলেন। ‘হিন্দু যে ব্রাহ্মণের পদস্পর্শ করিয়া মিথ্যা বলিতে পারে, সে কথা সিরাজ-উদ-দৌলা বিশ্বাস করিতেন না; সে জন্য একবার উমাচরণের (উমিচাঁদ) ধর্ম শপথে প্রতারিত হইয়াছিলেন। মুসলমান যে কুরআন শরীফ মাথায় লইয়াও মিথ্যা কথা বলিতে সাহস করিবে, তাহা বিশ্বাস করিতে না পারিয়া সিরাজ-উদ-দৌলা আবার প্রতারিত হইলেন।’ বিদেশী এবং দেশী ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তের কারণে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ একটি প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। এ যুদ্ধ ছিল পরিকল্পিত ও সাজানো। সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের অধীনে ছিল নবাবের ৫০ হাজার সেনাবাহিনীর ৩৫ হাজার সৈন্য। তিনি পলাশীর যুদ্ধে একটি গুলি ছোড়ারও নির্দেশ দেননি, ২ হাজার মসনবদার ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভও একই ভূমিকা পালন করেন। মীর মদন ও মোহন লালের অধীনস্থ সৈন্যদের ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ সৈন্যের মোকাবেলায় এগিয়ে গেলে তাতেই ক্লাইভ রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হন। মীর মদন মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার সংবাদে ব্যাকুল হয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা মীর জাফরকে ডেকে তার পদতলে উষ্ণীষ রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আবেদন জানান। মীর জাফর সেদিন নবাবকে যুদ্ধে বিরতি দেয়ার পরামর্শ দেন। রায় দুর্লভ তাকে মুর্শিদাবাদ যেতে বলেন। নবাব মোহন লালকে আক্রমণ থামানোর নির্দেশ দেন, নবাবের বারংবার আদেশে বিরক্ত হয়ে মোহন লাল আক্রমণ বন্ধ করলে নবাব সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, এই সুযোগে ইংরেজ বাহিনী নবাব বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিদের সুসজ্জিত বাহিনী ইংরেজদের কোনো প্রকার বাধা না দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। কেবল ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রে নিজের স্বল্পসংখ্যক সেনা নিয়ে ইংরেজদের বাধা প্রদান করতে থাকেন। কিন্তু তিনি একা ইংরেজদের গতিরোধ করতে পারলেন না। অপরাহ্ন ৫টার সময় ইংরেজ বাহিনী নবাবের পরিখাবেষ্টিত শিবির অধিকার করে নেয়। নবাব অবশ্য ইতঃপূর্বেই মুর্শিদাবাদ রওনা হয়ে যান। এভাবে পলাশী যুদ্ধ শেষ হয়।
এই যুদ্ধে নবাবের ৩৫ হাজার পদাতিক, ১৫ হাজার অশ্বারোহী ও ৫৩টি কামান ছিল যার মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার সৈনিক বিশ্বাসঘাতক তিনজন সেনাপতির অধীনে ছিল। ইংরেজদের ছিল ৯০০ ইউরোপিয়ান, ১০০ গোলন্দাজ ও ২ হাজার ১০০ দেশীয় সিপাই। এই তথাকথিত যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষে নাকি ৭০ জন হতাহত হয়।
২৩ জুন ক্লাইভ পলাশী থেকে ফিরে তিন ক্রোশ উত্তরে দাদপুরে এসে মীর জাফরকে বাংলা, বিহার উড়িষ্যার নবাব বলে অভ্যর্থনা জানান। দাদপুর থেকে প্রথমে মীর জাফর ও পরে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেন। ক্লাইভ ২৯ জুন পর্যন্ত কাশিম বাজারে ছিলেন এবং সেদিনই মুর্শিদাবাদ উপস্থিত হয়ে মীর জাফরকে সিংহাসনে বসান।
ইংরেজদের এদেশে শাসন ও রাজ্য বিস্তারের যে পরিকল্পনা লর্ড ক্লাইভ করেছিলেন তাতে সহযোগিতা ও দেশের স্বাধীনতাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দায়ী এদেশের কতিপয় স্বার্থান্বেষী ও ষড়যন্ত্রকারী। পলাশী যুদ্ধের ফলেই প্রায় ২০০ বছর ধরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা তথা অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভাগ্যচক্র আবর্তিত হয় ইংরেজদের হাতে। ক্লাইভ প্রথমে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে কেন্দ্র করে ভারতে যে আঞ্চলিক ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করলেন, অতি অল্পকালের মধ্যেই তা সারা উপমহাদেশে প্রসারিত হয়েছিল।
ইংরেজদের শাসন-শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ দেশের সিপাহিরা ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পলাশীর ১০০ বছর পর সিপাহিরা ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যর্থতার জন্যও দায়ী স্বদেশী শক্তির চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতা। সেদিন যদি দেশীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশ উদ্ধার বা স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিপাহিদের পাশে দাঁড়াতো তাহলে স্বাধীনতার জন্য আমাদের আরও একশত বছর সংগ্রাম করতে হতো না।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজের তিনটি নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল এবং তা একজন দেশপ্রেমিকের কাছে ন্যায়সঙ্গত।
১. ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার সংস্কার ও এটাকে দুর্ভেদ্য ও সুসংহত করার প্রচেষ্টা
২. দস্তকের বা বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার করা
৩. নবাবের অপরাধী ও শাস্তিপ্রাপ্ত প্রজা ও কর্মচারীদের কলকাতায় বেআইনি আশ্রয় দেয়া।
১৭৫৬-৫৭ সালে একজন ইউরোপীয় পর্যটক বাংলাকে দেখে লিখেছিলেন, বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, এখানে পারসিক, আবিসিনিয়ান, আরব, চীনা, তুর্কি, ইহুদি, আর্মানি ব্যবসায়ীরা দলে দলে আসতে থাকে। ফার্সিভাষী ঐতিহাসিকরা বাংলার নামকরণ করেছিলেন, ‘জান্নাতুল বিলাদ’ বা সুবাহগুলোর স্বর্গ। সব মোগল ফরমানেই বাংলাকে ‘জান্নাতুল হিন্দুস্তান’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের বলেছিলেন, ‘বাংলা এতই সম্পদশালী ছিল যে, এখানে একটি প্রবাদ চালু ছিল-বাংলায় প্রবেশের দরজা অসংখ্য কিন্তু বের হবার দরজা একটিও নেই’। ঐতিহাসিক ও পর্যটক আলেকজান্ডার ডো লিখেছেন, ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দাঁড়িপাল্লা বাংলার অনুকূলেই ভারী ছিল এবং বাংলা একমাত্র পাত্র ছিল যেখানে সোনাদানা এসে শুধু জমতো, তার কিছুই বের হতো না’। ১৭৩৫ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিপত্রে বলা হয়েছে, সারা ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাই হচ্ছে একমাত্র সস্তা গন্ডার প্রাচুর্যে ভরা দেশ। নবাব আলীবর্দীর শাসনের সময় (১৭৪০-৫৬) ছিল বাংলার গৌরবোজ্জ্বল যুগ। ইংরেজরা মূলত একটি লুটেরা জাতি। শক্তি দিয়ে পর সম্পদ লুণ্ঠন করাই ছিল তাদের পেশা। এক সময় তারা নাকি সমুদ্র ডাকাত ছিল। বাংলার সম্পদ তাদের প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট করেছে। ওই সময়ে বাংলায় আরও অনেক বিদেশী কোম্পানি ব্যবসা করতো। একমাত্র ইংরেজরাই অন্য দেশের ব্যবসায়ীদের দাঙ্গা হাঙ্গামা করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
পলাশী ষড়যন্ত্রের যারা নেতৃত্ব দিয়াছিল; ‘পরবর্তীকালে তাহাদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হইয়াছিল। প্রায় সকলেরই মৃত্যু হইয়াছিল মর্মান্তিকভাবে। কাউকে নির্মমভাবে হত্যা করা হইয়াছে, কেহ দীর্ঘদিন কুষ্ঠ রোগে ভুগিয়া মারা গিয়াছে, কাউকে ফাঁসিতে ঝুলাইয়া মারা হইয়াছে, কাউকে নদীতে ডুবাইয়া মারা হইয়াছে, কেহ নিজের গলায় নিজেই ছুরি বসাইয়াছে। অস্বাভাবিক পন্থায় এবং অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে আলিঙ্গন করিতে হইয়াছে মৃত্যুকে।
তাহাদের সকলের ওপরই পড়িয়াছিল আল্লাহর লানত।’ চলুন জানার চেষ্টা করি কার ভাগ্যে কী ঘটেছিল :
মীর জাফর : বিশ্বাসঘাতকদের সর্দার মীর জাফর পবিত্র কুরআন শরীফ মাথায় রেখে নবাবের সামনে তার পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করার পরপরই বেঈমানি করেছিলেন। তার জামাতা মীর কাসেম তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পরবর্তীতে তিনি দুরারোগ্য কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ভবিষ্যতে বাংলা অভিধানে বিশ্বাসঘাতকের সমার্থক শব্দ হিসেবে মীর জাফর দেখলে মোটেও অবাক হবো না।
জগৎ শেঠ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ : মীর কাসেম তাদের হত্যা করে। জগৎ শেঠকে দুর্গের চূড়া থেকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হয়।
রায় দুর্লভ : যুদ্ধের পর তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
উমির্চাঁদ : যুদ্ধের পর রবার্ট ক্লাইভ কর্তৃক প্রতারিত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং উন্মাদ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে তার মৃত্যু ঘটে।
রাজা রাজবল্লভ : পদ্মায় ডুবে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
মীর কাসেম : মীর জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। পরবর্তীতে ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাধে ও বকসারের যুদ্ধে পরাজিত হন। পরে ইংরেজদের ভয়ে পালিয়ে বেড়ান এবং অজ্ঞাতনামা অবস্থায় দিল্লিতে তার করুণ মৃত্যু ঘটে। তার মাথার কাছে পড়ে থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব মীর কাসেম হিসেবে ব্যবহৃত চাপকান। এ থেকেই জানা যায় মৃত ব্যক্তি বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাসেম আলী খান।
ইয়ার লতিফ খান : তিনি যুদ্ধের পর হঠাৎ করে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যান। ধারণা করা হয়, তাকে গোপনে হত্যা করা হয়েছিল।
মহারাজা নন্দকুমার : তহবিল তছরুপ ও অন্যান্য অভিযোগের বিচারে নন্দকুমারের ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু হয়েছিল।
মীরণ : মীর জাফরের বড় ছেলে মীরণ। অসংখ্য কুকর্মের নায়ক এই মীরণ। ইংরেজদের নির্দেশে এই মীরণকে হত্যা করে মেজর ওয়ালস। তার এই মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইংরেজরা বলে বেড়ায় যে বজ্রপাতে মীরণের মৃত্যু ঘটে।
ঘষেটি বেগম : মীরণের নির্দেশে নৌকা ডুবিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
মুহাম্মদী বেগ : নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার হত্যাকারী। কথিত আছে মৃত্যুর সময় নবাব তার কাছ থেকে দুই রাকাত সালাত আদায় করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু কুখ্যাত মুহাম্মদী বেগ সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে নবাব সিরাজকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তী পর্যায়ে মুহাম্মদী বেগ মাথা গড়গড় অবস্থায় বিনা কারণে কূপে ঝাঁপ দেয় এবং মৃত্যুবরণ করে।
দানিশ শাহ বা দানা শাহ : অনেকে বলে, এই ফকির নবাব সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিল। আসকার ইবনে শাইখ তার ‘মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা’ গ্রন্থে লিখেছেন, বিষাক্ত সাপের কামড়ে দানিশ শাহর মৃত্যু ঘটেছিল।
রবার্ট ক্লাইভ : নবাব সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। পলাশী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কোটি টাকার মালিক হন। ইংরেজরা তাকে ‘পলাসি হিরো’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই রবার্ট ক্লাইভ দেশে ফিরে গিয়ে একদিন বিনা কারণে বাথরুমে ঢুকে নিজের গলায় নিজের হাতেই ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।
ওয়াটস : মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় বিদেশের মাটিতেই হঠাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন।
স্ক্রাফটন : বাংলার বিপুল সম্পদ চুরি করে বিলেতে যাওয়ার সময় জাহাজ ডুবে তার অকাল মৃত্যু ঘটে।
ওয়াটসন : ওয়াটসনের ক্রমাগত স্বাস্থ্যহানি হলে কোনো ওষুধেই ফল না পেয়ে কলকাতাতেই করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি হন।
বাংলায় মুসলমানদের শক্তিকে খর্ব করে পরাধীন করতে ব্রিটিশ তরবারির সাথে হিন্দু ধনপতিদের অর্থভান্ডারও সমানভাবে সহযোগিতা করেছিল’। শেঠরা শুধু ইংরেজদেরকেই টাকা দেয়নি, সিরাজ-উদ-দৌলার অনেক সৈন্যকে পর্যন্ত অর্থ দিয়ে নিষ্ক্রিয় রেখে বাংলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। আরও দুঃখের কথা হলো বন্দী সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করার প্রস্তাব এই জগৎশেঠই দিয়েছিল।
নব্য মীর জাফরদের আনাগোনা আমাদের দেশে এখন বেশি। আড়াল করা ইতিহাস জাতিকে ও নতুন চেতনাময় প্রজন্মকে জানাতে হবে ভালো করেই। শুধুমাত্র মঞ্চ নাটকে সিরাজকে আনলেই চলবে না। সিরাজ আমাদের জাতীয় বীর, সিরাজ আমাদের অনুপ্রেরণা। পলাশী ট্র্যাজেডি হতে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। ১৭৫৭ সালের বাংলার মতোই আজকের বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে চলছে এক ধরনের ষড়যন্ত্র। সময়ের সাথে সাথে পাল্টেছে ষড়যন্ত্রের ধরন। একদা অর্থসম্পদ হলেও আজ তাদের লক্ষ্য এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ, যা ধ্বংস করা গেলেই সম্ভব এ দেশ ও জাতির অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধক্ষমতাকে ধ্বংস করা। এ পরিস্থিতিতে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে পলাশীর বিপর্যয় থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে করা যাবে। নয়তো ইতিহাসের সেই নির্মম সত্যই বাস্তবে পরিণত হবে যে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়ার কারণেই বিপর্যয় নেমে আসে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আজ আমাদেরকে নব্য মীর জাফর, জগৎশেঠ ও রায়দুর্লভদের চিহ্নিত করতে হবে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে এখনও যে মারাত্মক কোন্দল এবং হিংসা-প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে, তাতে আমার ভয় হয় আমরা কি স্বাধীনতা হারাতে বসেছি? সময় থাকতে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। আর যেন এই সোনার বাংলায় পলাশী আর সৃষ্টি না হয়।
সিরাজ-উদ-দৌলার ইতিহাস আমাদের জাতীয় ইতিহাস। এ ইতিহাস নিজেদের শিক্ষা নেয়ার ইতিহাস। এ শিক্ষা দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশী-বিদেশী শক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার শিক্ষা। কারণ এখনও মীর জাফর, উমিচর্ঁাদ, জগৎশেঠরা সক্রিয় ও শক্তিশালী। আধুনিক বিশ্বেও সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে সকল দিক থেকে কোণঠাসা করতে ইসলামবিরোধী পরাশক্তিগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই মুসলমানদের সময় এসেছে পলাশীর মর্মান্তিক পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণের।
মন্তব্য