শহীদেরা কখনও মরে না।” আমরা জানি সকল মানুষই মরণশীল। শহীদেরা অন্যের চাইতে আরও নির্মমভাবে হাত-পা কর্তিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তারাও মৃত্যুর পর আর ফিরে আসেন না। তারা মরেন না, তাদেরকে মৃতদের মধ্যে শামিল করবে না। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে একাধিকবার বলেছেন,
“আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারাই জীবিত কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না।” (সূরা বাকারা : ১৫৪) মহান রাব্বুল আলামিন তার নিজের দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রত্যয়ে যারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাদের পথ চলা নিঃসন্দেহে বর্ণনাতীত কঠিন, এ কাঠিন্যের মাপকাঠি দিয়ে তিনি মহান প্রভু তার অতি প্রিয় বান্দাদেরকে বাছাই করে নেন। কিছু বান্দার জীবনকে কবুল করে নিয়ে একটি আদর্শের বুনিয়াদ দুনিয়ার মানুষের জন্য তৈরি করে নেন সত্যের সাক্ষ্য রূপে। শহীদ ভাইদের স্মৃতি আল্লাহর প্রিয়তা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। পথ চলতে চলতে যখন নানা মোহ ভীতি আশঙ্কা আমাদের পথ আগলে দেয় তখন হৃদয়ের মাঝে অমর হয়ে থাকা শহীদের স্মৃতি আমাদের মনে আশার দ্বীপ শিখা জালায়। অং ঃযব ংঃধৎ ঃযধঃ ধৎব ংঃধৎৎু রহ ঃযব ঃরসব ড়ভ ড়ঁৎ ফধৎশহবংং অর্থাৎ শহীদরা মিল্লাতের জীবন, মিল্লাতের গৌরব দুর্যোগের রাহবার। হতাশাগ্রস্ত মুসাফিরের জন্য তারা দিশাহারা ধ্রুব তারা। শোহাদায়ে কারবালা মুজাহিদদের হৃদয়ে তাইতো সৃষ্টি করে চলছে বিপ্লবের জজবা। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব পৃথিবীর চিরন্তন ইতিহাস। মানুষ যখন অন্যায় অত্যাচার আর অসত্যে নিমজ্জিত, শয়তান তার অনুসারীদের সাথে নিয়ে পৃথিবীতে শয়তানি শক্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত; তখন আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে যুগে যুগে পাঠিয়েছেন অসংখ্য নবী-রাসূল ও তাদের সঙ্গী সাথী হিসাবে প্রেরণ করেছেন দ্বীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারী মর্দে মুজাহিদ। নবী-রাসূলদের পর তাদের উত্তরাধিকারীরা এ দায়িত্ব পালনে ব্রত হন। তারা শয়তানি শক্তি নির্মূলের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন এমনকি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সাক্ষী হয়ে আছেন।
হৃদয়ের গহিন কোণে
রক্ত ঝরায় ক্ষণে ক্ষণে।
অশ্রুজলের বানে ডেকে যায়
রুখবে কে তা সাহস কোথায়।
তুমি ছাড়া সারাটি ক্ষণ
ডুকরে কাঁদছে পাগল হৃদয়।
ডানা ভাঙা পাখির মত
ক’টা দিন আর পার করা যায়
শহীদ নোমানী ইসলামী আন্দোলনের সেনানীদের জন্য একটি প্রেরণার নাম। যার অসাধারণ মেধা, অতুলনীয় চরিত্র, অনুপম কথামালা, অমায়িক ব্যবহার, পরোপকারী মনোভাব আর আল্লাহভীরু মানসিকতা আমাদের প্রেরণার উৎস। পিতা-মাতার আশা ছিল পড়াশুনা শেষ করে তাদের মুুখ উজ্জ্বল করবেন। কিন্তু প্রভুর প্রেমে পাগল দ্বীনের পথে এ মুজাহিদ দুনিয়ার এ ক্ষুদ্র সার্থে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে ছিলেন অনেক দূরে। পৃথিবীর অজানা সবচেয়ে বড় ডিগ্রি পাওয়ার যিনি অধিকারী তিনি কি আর ছোট কোন ডিগ্রির অপেক্ষায় থাকেন? পাড়া-প্রতিবেশীরা ছিল শহীদ নোমানীর প্রিয় শুভাকাক্সক্ষী। বাড়ি গেলেই সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতেন, খোঁজখবর নিতেন, সালাম বিনিময় করে তাদের পারিবারিক কুশলাদি জানতেন। নামাজে ডাকতেন, আর দরদভরা মন নিয়ে মানুষকে ইসলামের কথা বুঝাতেন।
শহীদি ক্যাম্পাসে শহীদের মিছিলে এক অগ্রসেনানী শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানী। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ তিনি এই মিছিলে যোগ দেন। সেদিন ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন প্রিয় নামটি শরীফুজ্জামান। চলে গেছেন জান্নাতে তাঁর প্রভুর সন্নিকটে। জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ এবং মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়। আল্লাহ এরশাদ করেন, কোন আত্মার মৃত্যু হয় না আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া যা তার জন্য লিপিবদ্ধ। (সূরা আলে ইমরান : ১৪৫) আর শহীদ হিসাবে যদি আল্লাহ মৃত্যু নির্ধারণ করে থাকেন; তাহলে কারো সাধ্য নেই মৃত্যুকে ঠেকানোর। আর তা যদি না হয়ে থাকে তাহলে এমন কোন শক্তি নেই মৃত্যু কার্যকর করার। আর শাহাদাতের মৃত্যুই শুধু পারে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিতে। আমি কি ক্ষমা চেয়ে প্রার্থনা করব যে, আমাকে জান্নাত থেকে বাঁচাও? মৃত্যকে জয় করল এ সাহসী উচ্চারণ। এ হল আল্লাহতায়ালার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আল্লাহতায়ালার অমিয় বাণী
‘প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী আর মৃত্যু এক অনিবার্য বাস্তবতা। মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু একদিন সবাইকে মরতে হবে সে বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বেশেষে কোন মতপার্থক্য নেই।
শহীদ নোমানীর শাহাদাতের তামান্না : নোমানী ভাইয়ের শাহাদাতের এক মাস পূর্বে। মুজিব হল এবং শেরেবাংলা হলের সাথীদের নিয়ে মুজিব হলে শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত হয়। সেই শিক্ষা শিবিরের প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি শরীফুজ্জামান নোমানী ভাই। সাথে ছিলেন ইসলামিক স্ট্যাডিজের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল-মামুন স্যার। নোমানী ভাই তার বক্তব্য শেষে দোয়া করার পূর্ব মুহূর্তে ক্যাম্পাসের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরলেন এবং বাতিল শক্তিরা যেভাবে সত্য ও ন্যায়ের আাহবানকে স্তব্ধ করার যে কূটকৌশল চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে বললেন। একপর্যায়ে নোমানী ভাই বললেন। এ ক্যাম্পাসে আাল্লাহর আওয়াজ উচ্চকিত করার জন্য আর যদি কোনো ভাইয়ের রক্তের প্রয়োজন হয়, আল্লাহ যেন আমাকে প্রথমে শহীদ হিসেবে কবুল করেন বলে দোয়া শুরু করলেন। প্রেমিক যেমন প্রেমিকার কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করে, ঠিক তেমনি নোমানী ভাই আল্লাহর কাছে তার শাহাদতের জন্য প্রচুর কাঁদলেন। দোয়া শেষ হলো দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে। আর সে দিনটি ছিল শুক্রবার। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯। ঠিক তার এক মাস পর ১৩ মার্চ ২০০৯ শুক্রবার দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে আজানের সময় তার মনিবের সান্নিধ্যে চলে যান। শহীদ নোমানীর সেই দোয়া আমার হৃদয়কে আজো নাড়া দেয়।
শহীদ নোমানীর অপরাধ : যে অপরাধে শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানীকে তাগুতি শক্তির অনুসারী আওয়ামী গু-াবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে, তার অপরাধ সে মানুষকে কোরআনের দিকে আহবান করত, কোরআনের শিক্ষা দিত, হাদিসের কথা বলত। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি মানুষকে আহবান করত। সে বাংলাদেশেকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখত। আর এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কারণেই ১৩ মার্চ ২০০৯ সালে সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল পরোপকারী এই তরুণটিকে ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। তাকে যেভাবে হত্যা করা হয় তা গোটা দেশবাসী কখনো কল্পনা করতে পারেনি।
নোমানী ভাইয়ের শাহাদাতের প্রেক্ষাপট : ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের গু-াদের সশস্ত্র আক্রমণে নিহত শিবিরের ৪ জন নেতাকর্মীর শাহাদতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১১ মার্চ ’০৯ তারিখে ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ র্যালি শেষে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশ চলাকালীন সময়ে সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিবিরের সমাবেশে হামলা করে। ছাত্রশিবির চরম ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ক্যাম্পাসে পড়ালেখার পরিবেশ অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে তাদের দখলদারিত্ব কায়েম করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তাই পর পর দুই দিন পুলিশ হলগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে বৃহস্পতিবার রাতভর পুলিশ ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীসহ ৭৬ জন নিরীহ ছাত্রকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গ্রেফতার করে কোর্টে চালান দেয়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের জন্য ক্যাম্পাস উন্মুক্ত করে দেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চালানো হয় এই গ্রেফতার অভিযান। শুক্রবার সকাল থেকে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে অস্ত্র এনে ছাত্রলীগের সন্ত্র¿¿াসীরা হলসমূহে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। পুলিশের উপস্থিতিতে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে বিশ্ববিদ্যালয় হলসমূহ ও পাশের এলাকার ছাত্রাবাসসমূহে নিরীহ ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয় শফিকুল ইসলাম, জিন্নাহ, আশরাফ হোসেন, মাহবুব, আবু রায়হান, মাহফুজসহ অর্ধশতাধিক ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্র। অপর দিকে সন্ত্রাসীরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ আলমসহ ১০-১৫ জন ছাত্রকে শেরেবাংলা হলে জিম্মি করে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করতে থাকে। তাদের উদ্ধারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিকামী শিক্ষকবৃন্দ হলের প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটরগণ সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সরাসরি ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনে বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ প্রশাসনের কক্ষে অব্যাহত অনুরোধ সত্ত্বেও হলগুলোতে জিম্মি হয়ে পড়া নির্যাতিত ছাত্রদের উদ্ধারের কোনো প্রকারের কার্যকর সহযোগিতা পাননি। শিবির নেতৃবৃন্দ বারবার অনুরোধ জানালেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এবং পুলিশ তাদের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করে। এমতাবস্থায় ১১টা ৩০ মিনিটে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি শরীফুজ্জামান নোমানী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও পুলিশের সাথে কথা বলে আটককৃতদের সাথে দেখা করার জন্য শেরেবাংলা হলে যাওয়ার পথে পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী আওয়াল কবির জয়, ছাত্রলীগ সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন মুন, দ্বীপায়ন সরকার দ্বীপ, আরিফুজ্জামান রনি, মঈন, জাহাঙ্গীর, সাইফুল, মুরাদ, সোহেল, মোশাররফ, ফুয়াদ, উজ্জ্বল, শামীম, অনিক, শান্ত, জাকারিয়াসহ কতিপয় বহিরাগত সন্ত্রাসীরা শরীফুজ্জামান নোমানীসহ মাহবুব, শফিকুল ইসলাম, জিন্নাহ, আশরাফ হোসেনদেরকে টেনেহিঁচড়ে হলের পূর্ব প্রাচীরের দিকে নিয়ে যায়। এই সময় আওয়াল কবীর জয় বলে ওদের খুন করে ফেল। তখনই এক সন্ত্রাসী তার হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে নোমানীকে হত্যার উদ্দেশে আঘাত করে। নোমানী ডান হাত দিয়ে ঠেকালে ডান বৃদ্ধাঙুলটি কেটে পড়ে যায়। এরপর দ্বীপের হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে নোমানীর মাথায় আঘাত করলে মাথা কেটে মগজ বের হয়ে যায় এবং গুরুতর রক্তাক্ত যখম হয়ে মাটিতে লুটে পড়েন। দুঃখজনক হলেও সত্য, পুলিশ তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নোমানীকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে।
শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের নিকট অতিপরিচিত একটি নাম। সদালাপী, বিনয়ী, সদাহাস্যোজ্জ্বল নোমানী মানব রক্তের নেশায় উন্মত্ত হিংস্র আওয়ামী হায়েনাদের বিষাক্ত নখরাঘাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিলেন। মানবরূপী দানব খুনি সন্ত্রাসীরা সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মম বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে হীন মানসিকতার সূচনা করে। খুনিরা মনে করেছে নোমানীর মতো তেজোদীপ্ত ঈমানের অধিকারী ছাত্র নেতাকে হত্যা করে দ্বীন বিজয়ের আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু পৃথিবীর মানবসভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী যারা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের জীবনের অমূল্য সম্পদ বিলিয়ে দেয়, তারা মরেও চির অমর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বীন কায়েমের অতন্দ্র প্রহরীদের প্রাণের স্পন্দন যতদিন থাকবে ততদিন শহীদ নোমানীর সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস স্বর্ণালি অক্ষরে অক্ষুণœ থাকবে। শহীদ নোমানীর প্রতি ফোঁটা রক্ত মতিহারের সবুজ চত্বরে অভিশপ্ত ঘাতকদের প্রতি অভিশাপের তীর প্রতিনিয়ত নিক্ষিপ্ত হবে। সময়ের ব্যবধানে আবারো ছাত্রছাত্রীদের পদভারে মুখরিত হবে রাজশাহীর মতিহারের সবুজ চত্বর। রাজশাহীর আম্রকাননে পাখিদের কলকাকলিতে উদিত হবে ভোরের সোনালি আকাশ। দিনান্তে বলাকারা ফিরে যাবে নীড়ে, ছাত্রছাত্রীরা মুখরিত ক্যাম্পাস থেকে ফিরে আসবে স্ব-স্ব হলে। শুধু পাওয়া যাবে না শহীদ নোমানীর হাসিমাখা প্রাণের স্পন্দন। জাগতিক নিয়মে এসএম হলের ছাত্ররা তাদের চিরচেনা বন্ধুবাৎসল্য শহীদ নোমানীকে আর খুঁজে পাবে না। মসজিদের মিনারে মোয়াজ্জিনের মধুরকণ্ঠে ধ্বনিত হবে আজান, কিন্তু এই সেই নামাজের ইমাম শহীদ নোমানী আজ শুধুই মধুময় স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর কোন দিন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সোনালি স্বপ্ন নির্মাণের গান গেয়ে ফিরে আসবে না প্রিয়তম বাবা-মায়ের কাছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের অধিকার আদায়ে সদা তৎপর শহীদ নোমানীকে আর দেখতে পাওয়া পাওয়া যাবে না মিছিলে, মিটিংয়ে আর আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রসারিতে। নশ্বর এই মায়াময় পৃথিবীর জীবনের সমস্ত মায়াজাল ছিন্ন করে শহীদ নোমানী চলে গেছে না ফেরার দেশে মহান প্রভুর ডাকে। শহীদ নোমানী তাঁর বহুমুখী প্রতিভার গুণে ছাত্রসমাজের নিকট চির অমর হয়ে থাকবেন। যদিও জাগতিক নিয়মে শহীদ নোমানী আর কখনো ফিরে আসবেন না মতিহারের চিরচেনা প্রিয় ক্যাম্পাসে। কিন্তু শহীদ নোমানী মোমেনশাহী জেলার ফুলবাড়ীয়া থানার নিভৃত পল্লীর জান্নাতের বাগানে শুয়ে প্রতি নিয়ত অনুভব করবেন তাঁর রেখে যাওয়া কালজয়ী আদর্শের সাক্ষী প্রিয় ক্যাম্পাসকে।
শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানীর স্বপ্ন : নোমানী ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্র। যেখানে থাকবে না কোন হানাহানি মারামারি, চলবে না কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি। যে দেশের মানুষ থাকবে না ক্ষুধার্ত, সকলের মনে থাকবে অবিরাম আনন্দ। যে দেশে চলবে না কখনও অর্থনৈতিক মন্দা, থাকবে যাকাতব্যবস্থা। দেশটা পরিচালিত হবে আল কোরআন এবং আল-হাদিসের আলোকে। শিক্ষার হার হবে ১০০%। অশিক্ষিত বলে কোন শব্দ থাকবে না। তার সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য ছাত্রদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতেন এবং সে যতটুকু পেরেছিলেন তার পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। আজ শহীদ নোমানী ভাই আর আমাদের মাঝে নাই তবে সে রেখে গেছেন তার অসমাপ্ত কাজ। ইসলামী আন্দলনের কর্মী হিসাবে একজন সত্যিকার মুসলমান হিসাবে তার এ অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করার দাবিদার কেবল আমরাই।
ছেলে সম্পর্কে বাবার অভিব্যক্তি : আমার ছেলে নোমানী সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় শুধু এটুকুই বলতে চাই, একজন বাবা হিসেবে তার দিকে যখন তাকিয়ে দেখতাম তখন পবিত্র ও সুখময় এক আত্মিক অনুভূতিতে হৃদয়টা আমার জুড়িয়ে যেতো। চোখ দুটো ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্নে ভরে উঠতো। কী যে মায়াবী তার ঐ পবিত্র চেহারা। কত যে সম্ভাবনা ছিল তার মাঝে। কিন্তু ওরা বাঁচতে দিল না আমার নোমানীকে। কী অপরাধ ছিল তার? বাবার সবচেয়ে প্রিয়, সচ্চরিত্রবান, খোদাভীরু ও সুযোগ্য সন্তান হাওয়াটাই কি তার অপরাধ? আল কুরআনের দিকে ছাত্রদেরকে আহ্বান করাই কি তার অপরাধ? কয়জন বাবা এমন সন্তানের বাবা হতে পারে? কিন্তু সে রকম সৌভাগ্যবান বাবা হয়েও অকালে সেই সন্তানের কফিন কাঁধে নিতে হলো আমাকে! ছোটকাল থেকেই সে পরোপকারে সময় দিত, মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিত না, সবসময় সত্যকে ভালবাসতো, বই পড়ার প্রতি তার ছিল নেশা, সময়ের মূল্য দিতে জানত, সময়ের কাজ সময়েই করত, তার জ্বলন্ত প্রমাণ ভার্সিটির মারামারিতে কারও অপেক্ষা না করে, কালক্ষেপণ না করে সময়মত তার সাথী ভাইদেরকে উদ্ধার করে সে অকাতরে নিজের জীবন দান করে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে।
যে বাবা-মা তার সন্তানকে হারিয়েছেন, যে বোন তার ভাই হারিয়েছে তাদের সান্ত¡না দেয়ার ভাষা আমাদের নেই। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন, তার পিতা-মাতাদের ও আত্মীয় স্বজনদের ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দান করেন এবং শরীফ্জ্জুামান নোমানী ভাইকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেন। আমিন।
নাম : মো: শরীফুজ্জামান নোমানী
পিতার নাম : মো: হাবিুল্লাহ মাস্টার
সাংগঠনিক মান : সদস্য
সর্বশেষ দায়িত্ব : সেক্রেটারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ পড়াশুনা : এমএ ইসলামিক স্টাডিজ এমবিএ মার্কেটিং (দ্বিতীয় সেমিস্টার)
শহীদ হওয়ার স্থান : শেরেবাংলা হলের পূর্ব পার্শ্বের প্রাচীরসংলগ্ন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আঘাতের ধরন : রামদা দ্বারা আঘাত, এতে ডান হাতের বৃদ্ধাঙুল কেটে পড়ে যায় এবং মাথা দ্বিখ-িত হয়। হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রলীগ।
শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৩ মার্চ ২০০৯ ইং
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: আন্ধারিয়া উত্তর পাড়া, থানা : ফুলবাড়ীয়া, জেলা : ময়মনসিংহ।
ভাইবোন : ৪ ভাই ২ বোন। ভাইবোনদের মাঝে তার অবস্থান ছিল পঞ্চম।
পিতা : জীবিত পেশা : শিক্ষক
মাতা : জীবিত পেশা : গৃহিণী
শহীদ নোমানী ভাইয়ের স্মরণীয় কথা : আমাদের পায়ের নিচের মাটি থেকে মাথার ওপরের আসমান পর্যন্ত সকল ক্ষমতাসীন পদে আজ ইসলামবিরোধীরা অবস্থান করছে। তবে ভয় পাবার কিছু নেই আসমানে ওপর যিনি আছেন তিনি আমাদের পক্ষে।
মাতার প্রতিক্রিয়া : আজ আমার নোমানী যদি থাকত আমার বুকের সমস্ত শূন্যতা পূরণ হয়ে যেত। তোমরা বল কী অপরাধ ছিল আমার নোমানীর? সে কি কোন মানুষের ক্ষতি করেছিল? কেন তারা আমার বুকের ধনকে নির্মমভাবে হত্যা করল?
পিতার প্রতিক্রিয়া : নোমানীকে হারিয়েছি আমি। কিন্তু তাতে আমার কোন দুঃখ নেই। কাল কিয়ামতের দিন আমার শহীদ সন্তানের সাথে পিতা হিসেবে জান্নাতের সিঁড়িতে দেখা হবে এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
মন্তব্য