ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক মুহাব্বত

যাবতীয় প্রশংসা মহান আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তিনি মানবজাতিকে একে অপরের প্রতি কল্যাণ সাধনের জন্য সৃষ্টি করেছেন, অন্তরে দান করেছেন মুহাব্বত। মুহাব্বত বা ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমাদের জীবনে ভালোবাসা আছে বলেই জীবনকে অনেক সুন্দর মনে হয় এবং নানাবিধ কাজে প্রেরণা খুঁজে পাই। আমাদের দ্বীন, ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে এই ভালোবাসা কেননা এর মাধ্যমেই মানুষের মৌলিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। অন্য দিকে, ঈমান ও তাওহিদের মূল ভিত্তিও এই ভালোবাসা। হজরত আনাস ইবনু মালিক (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা:) বলেছেন, “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা যা পছন্দ করো তা অন্য ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করবে। আরো বর্ণনায় রয়েছে, প্রতিবেশীর জন্যও পছন্দ করবে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৭৪)

মুহাব্বত অর্থ হচ্ছে আগ্রহ উদ্দীপনা, প্রেম-ভালোবাসা, ঝুঁকে পড়া। কোন বস্তুর মধ্যে পূর্ণ বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে তার প্রতি মনের আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়াকে মুহাব্বত বলে। প্রিয় কোন ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি আকর্ষিত হওয়াকে মুহাব্বত বলে।

মুহাব্বত তিন প্রকার:
স্বভাবগত মুহাব্বত (মুহাব্বতে তাবায়ি): বাহ্যিক কোন প্রভাব ব্যতিরেকে শুধুমাত্র অন্তরের টানে কোন ভালোবাসাকে স্বভাবগত মুহাব্বত বলে। যেমন- সন্তান-সন্ততি ও পিতা-মাতার প্রতি ভালোবাসা।
জ্ঞানগত মুহাব্বত (মুহাব্বতে আকলি): কারও জ্ঞান গরিমায় মুগ্ধ হয়ে নিজের বিবেক তাড়িয়ে তার প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা। যেমন- কোন জ্ঞানী ব্যক্তিকে ভালোবাসা।
ঈমানগত মুহাব্বত (মুহাব্বতে ঈমানি): শুধুমাত্র ঈমানের তাগিদে কাউকে ভালোবাসা। যেমন- আল্লাহ ও তার রাসূল (সা:)-এর প্রতি ভালোবাসা, সাহাবি-তাবেইনদের প্রতি ভালোবাসা, দ্বীনি ভাইদের প্রতি ভালোবাসা।

মুহাব্বতের কারণ: একজন মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়ার জন্য যে কয়েকটি কারণ আছে-
সৌন্দর্য (জামাল): মুহাব্বত বা ভালোবাসার একটি কারণ হলো সৌন্দর্য। অর্থাৎ, সৌন্দর্য ও লাবণ্যতার কারণে ভালোবাসা হয়ে থাকে।
যোগ্যতা (কামাল): মুহাব্বতের দ্বিতীয় কারণ হলো গুণ বা যোগ্যতা। প্রসিদ্ধ উক্তি রয়েছে- “যোগ্যতা অর্জন কর, তাহলে বিশ্ববাসীর প্রিয়পাত্র হতে পারবে।”
নৈকট্য (কারাবাত): মুহাব্বতের তৃতীয় কারণটি হলো আত্মীয়তা বা নৈকট্য। রাসূল (সা:) এ ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন।
অনুগ্রহ (ইহসান): মুহাব্বত বা সম্পর্কের আরও একটি কারণ হচ্ছে অনুগ্রহ। একটি প্রবাদ রয়েছে- “মানুষ অনুগ্রহের দাস।”

আল্লাহ, রাসূল (সা:) ও মুমিনদের প্রতি ভালোবাসা
মুমিন বান্দাহর কাজই হলো আল্লাহর ইচ্ছার সাথে অন্তরকে একীভূত করা। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার সাথে চলা। সুতরাং তিনি যা মুহাব্বত করেন তা মুহাব্বত করা এবং তিনি যা অপছন্দ করেন, তা অপছন্দ করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান পালন করাই তার প্রতি মুহাব্বত। হযরত মুহাম্মদ (সা:) হলেন সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম নবী ও রাসূল। তাঁর ওপর ঈমান রাখা ও তাঁকে নিজের চেয়েও ভালোবাসা মুমিনের একান্ত কর্তব্য। পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরিফের একাধিক বর্ণনায় মুমিনদেরকে রাসূল (সা:) এর প্রতি অগাধ প্রেম-ভালোবাসা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন : “বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং বাসস্থান যাকে তোমরা পছন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করবেন না।” (সূরা আত তাওবাহ: ২৪) তিনি আরো বলেন: “নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ।” (সূরা আল আহজাব : ৬)

নবী (সা:) বলেন: “তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, সন্তান এবং সকল মানুষের চাইতে প্রিয় হই।” (বুখারি ও মুসলিম) আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম (রা:) থেকে বর্ণিত, “তিনি বলেন, আমরা নবী (সা:) এর সাথে ছিলাম। নবী (সা:) হযরত ওমর (রা:)-এর হাত ধরা ছিলেন। অতঃপর ওমর (রা:) রাসূল (সা:)কে বললেন, হে রাসূল আমি আপনাকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসি তবে আমার নিজের চাইতে বেশি নয়। নবী (সা:) বললেন, তাহলে হবে না; আল্লাহর শপথ! তোমার নিজের চাইতেও আমাকে বেশি ভালোবাসতে হবে। তখন ওমর (রা:) বললেন, এখন আমি আপনাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। অতঃপর নবী (সা:) বললেন: হে ওমর তাহলে এখন ঠিক আছে।” (সহিহ বুখারি)

আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী (সা:) বলেছেন, তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেÑ ১) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার নিকট অন্য সকল কিছু হতে অধিক প্রিয় হওয়া; ২) কাউকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা; ৩) কুফরিতে প্রত্যাবর্তনকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপছন্দ করা। (সহিহ বুখারি: হাদিস নং ১৬) আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদিস, নবী (সা:) বলেছেন, “সে মহান সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! কোন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা যা পছন্দ করো তা অন্য ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করবে। অথবা তোমার প্রতিবেশীর জন্য।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৭৫)

মুমিনদের পারস্পরিক সহানুভূতি ও মুহাব্বত
ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে মুমিনদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও মুহাব্বতের সম্পর্ক বজায় রাখা। ইসলাম এক পরিপূর্ণ সামষ্টিক শক্তির নাম। এর কার্যকারিতা যতখানি বাহ্যিক ততখানি অভ্যন্তরীণ। যেমন সূরা হুজুরাতের ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপস- মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে।” তাই তো দেখা যায়, মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্কে এক ধরনের স্থিতি, গভীরতা ও ব্যাপকতা বিদ্যমান। বর্ণিত আয়াতের ভিত্তিতে এভাবেই ঈমানদাররা প্রকৃত বন্ধু বাছাই করবে, বন্ধুত্বের এ সম্পর্কে কোনো বাহ্যিক সম্পর্ক নয়। দুনিয়ার লেনদেন, আদান-প্রদানে সীমাবদ্ধ নয়। এই সম্পর্ক আদর্শিক। তাই তার ধরনও ভিন্ন, অনেক মজবুত এবং আল্লাহর রহমত দ্বারা পরিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো এবং কখনও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমরা তোমাদের ওপর আল্লাহর সেই নিয়ামতের কথা স্মরণ করো, যখন তোমরা একে অপরের দুশমন ছিলে, অতঃপর আল্লাহতায়ালা (তার দ্বীনের বন্ধন দিয়ে) তোমাদের একের জন্য অপরের অন্তরে ভালোবাসা সঞ্চার করে দিলেন। অতঃপর তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহে ‘ভাই ভাই’ হয়ে গেলে। অথচ তোমরা ছিলে অগ্নিকুণ্ডের প্রান্ত সীমানায়। অতঃপর সেখান থেকে আল্লাহতায়ালা তোমাদের উদ্ধার করলেন, আল্লাহতায়ালা এভাবেই তার নিদর্শনগুলো তোমাদের কাছে স্পষ্ট করেন, যাতে তোমরা সঠিক পথের সন্ধান পাও।” (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)

হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী (সা:) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের পার্থিব কষ্টগুলোর মধ্য থেকে একটি কষ্ট দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার একটি বড় কষ্ট দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে দেয়, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে, আল্লাহও ততক্ষণ তাকে সাহায্য-সহায়তা করতে থাকেন।” (মুসলিম শরিফ: ২৪৫) মুসলিম শরিফের উল্লিখিত হাদিসটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের এমন কতগুলো কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা জীবন চলার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মাত্র চারটি কাজ উল্লেখ রয়েছে- ১. কষ্ট দূর করে দেয়া, ২. অভাব লাঘব করা, ৩. দোষ গোপন করা ও ৪. সাহায্য করা। হজরত আবু মাসউদ (রা:) বলেন, আমি একজন ভৃত্যকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলাম। এ সময় আমার পশ্চাতে একটা শব্দ শুনলাম: ‘জেনে রেখো, হে আবু মাসউদ! আল্লাহ তায়ালাই তোমাকে এ ভৃত্যের ওপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন।’ আমি বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আর কখনো দাস-দাসী ও চাকর-চাকরানীকে প্রহার করব না। আমি ওকে স্বাধীন করে দিলাম। রাসূলে করিম (সা:) বললেন, ‘এ কাজটি না করলে আগুন তোমাকে কেয়ামতের দিন ভস্মীভূত করে দিত।’ (সহিহ মুসলিম) মানবতার মহান বন্ধু রাসূল (সা:) মানবতার মুক্তির জন্যই কাজ করে গিয়েছেন। তিনি ছিলেন অসহায়, দুর্বল ও নির্যাতিতদের বিশ্বস্ত অভিভাবক, অধীনস্থদের প্রতি দয়াশীল, প্রতিবেশীদের প্রিয় বন্ধু ও অতি নিকট আপনজন। সুখে-দুঃখে তিনি তাদের পাশে থাকতেন।

সর্বোত্তম আমল
ইবাদত মূলত দুইভাগে বিভক্ত। এক. মহান আল্লাহর সাথে সপৃক্ত ইবাদত। তাকে হাক্কুল্লাহ বলে যেমন- সালাত, সিয়াম ইত্যাদি। দুই. বান্দার সাথে সম্পৃক্ত ইবাদত, যাকে হাক্কুল ইবাদ বলে। যেমন- মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা, মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা ইত্যাদি। ‘আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা:) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা:)কে জিজ্ঞেস করলো, ইসলামের কোন কাজটি শ্রেষ্ঠ? নবী (সা:) বললেন, “তুমি খাবার খাওয়াবে এবং তোমার পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সালাম দিবে।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে মুহাব্বত করল সে যেন আমাকেই মুহাব্বত করল। আর যে আমাকে মুহাব্বত করল সে আমার সাথে জান্নাতে বসবাস করবে। (তিরমিজি শরিফ)

আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, একদিন নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর খেদমতে এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিয়ামত কখন হবে?’ মুহাম্মাদ (সা:) বললেন, ‘তুমি কিয়ামতের জন্য কী সঞ্চয় করেছ?’ (যে কিয়ামত আসার ব্যাপারে এতো আগ্রহ) লোকটি বলল, ‘আমি এর জন্য বহু নামাজ রোযার সম্বল তো করতে পারি নাই, কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে আমার গভীর ভালোবাসা আছে।’ রাসূল (সা:) বললেন, ‘যে যার সাথে ভালোবাসা রাখবে, কিয়ামতের দিন সে তার সাথে থাকবে।’ অতএব তুমি আমার সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর সাথে সে আল্লাহরও সাথে। আনাস (রা:) বললেন, ‘আমি মুসলিমদের ঈমান আনার পর এত খুশি হতে আর দেখিনি। (বুখারি ও মুসলিম) আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর নিকট এলো। অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে বললো, হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! সে লোকটি সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন, যে একটি সম্প্রদায়কে মুহাব্বত করে অথচ সে তাদের সাথে মিলিত হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, যে যাকে মুহাব্বত করে সে তার সঙ্গেই থাকবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৬১১)
রাসূল (সা:) বলেন, “তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা পরস্পরকে না ভালোবাসা পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দিবো না যা করলে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে? (তা হলো) তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রসার ঘটাও।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৫৪) “তিনটি জিনিস যে ব্যক্তি একত্রিত করতে পারবে সে ঈমান একত্রিত করল- (১) নিজের ব্যাপারে ইনসাফ করা, (২) জগতের সকলকে সালাম দেওয়া, আর (৩) অল্প সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তা থেকে ব্যয় করা।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২৮) মুমিনদের সম্পর্ক কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়। প্রতিটি সম্পর্ক আল্লাহর জন্য। তাই তা সংরক্ষণে আল্লাহর নির্দেশ মানতে হবে।

পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে মুহাব্বতের গুরুত্ব
বস্তুত ইসলামী বিপ্লবের আহবায়কদের এ পারস্পরিক সম্পর্ক হচ্ছে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, রহমত ও ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু এর ভেতর ‘ভ্রাতৃত্ব’ শব্দটি এতো ব্যাপক অর্থবহ যে, অন্যান্য গুণরাজিকে সে নিজের ভেতরেই আত্মস্থ করে নেয়। অর্থাৎ দুই সহোদর ভাই যেমন একত্রিত হয় এবং তাদের মধ্যকার কোন মতপার্থক্য, ঝগড়া-ফাসাদ বা বিভেদকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পরস্পরকে ঠিক তেমনিভাবে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। দুই ভাই যেমন পরস্পরের জন্য নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়, পরস্পর পরস্পরের শুভাকাক্সক্ষী হয়, সাহায্য ও সহযোগিতায় নিয়োজিত থাকে এবং একে অপরের সহায়ক ও পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়; যেভাবে এক তীব্র প্রেমের আবেগ ও প্রাণচেতনার সঞ্চার করে, সত্য পথের পথিকদের (যারা দ্বীন ইসলামের খাতিরে নিজেদের গোটা জীবনকে নিয়োজিত করে দেয়) মধ্যে ঠিক তেমনি সম্পর্কই গড়ে ওঠে। মোটকথা ইসলামী বিপ্লবের প্রতি যে যতটা গভীরভাবে অনুরক্ত হবে, আপন সাথী ভাইয়ের সঙ্গে ততটা গভীর সম্পর্কই সে গড়ে তুলবে। তেমনি এ উদ্দেশ্যটা যার কাছে যতটা প্রিয় হবে, তার কাছে এ সম্পর্কও ততটা প্রিয় হবে। কারণ এ সম্পর্ক হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের। কাজেই যে ব্যক্তি ইসলামী বিপ্লবের কর্মী ও আহবায়ক হবে, আপন সাথী ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক যদি পথ চলাকালীন অপরিচিত লোকের মতো হয় তবে তার নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে দেখা উচিত যে, সে কোন্ পথে এগিয়ে চলেছে। অথবা আপন সঙ্গী-সহকর্মীদের সাথে তার সম্পর্ক যদি গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়া ধুলোর মত ক্ষণস্থায়ী হয়, তবে তার চিন্তা করে দেখতে হবে যে, যে উদ্দেশ্যের প্রতি মে ভালোবাসার দাবি করে, তার দিলে তার কতোটা মূল্য রয়েছে।

ভ্রাতৃত্বের এ সম্পর্কের জন্যই নবী করিম (সা:) আল্লাহর জন্য মুহাব্বতের মত পবিত্র, ব্যাপক ও মনোরম পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। ‘মুহাব্বত’ নিজেই এক বিরাট চিত্তাকর্ষক ও শ্রুতিমধুর পরিভাষা। এর সাথে ‘আল্লাহর পথে’ এবং ‘আল্লাহর জন্য’ বিশ্লেষণদ্বয় একে তামাম স্থুলতা ও অপবিত্রতা থেকে মহত্ত্বের উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। এমনিভাবে এ পরিভাষাটি দিল ও আকলকে যুগপৎ এমন এক নির্ভুল মানদণ্ড দান করে, যা দিয়ে প্রত্যেক মুমিন তার সম্পর্ককে যাচাই করে দেখতে পারে। আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার পথে মুহাব্বত এ দুটো জিনিসের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। যেখানে এর একটি থাকবে, সেখানে অপরটিও দেখা যাবে। একটি যদি না থাকে তবে অপরটি সন্দেহজনক হয়ে দাঁড়াবে। তাই নবী করিম (সা:) বলেছেন: “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না পরস্পরকে মুহাব্বত করবে।” (সহিহ মুসলিম) অতঃপর গোটা সম্পর্ককে এই ভিত্তির ওপর স্থাপন করা এবং মুহাব্বত ও শত্রুতাকে শুধু আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়াকে ঈমানের পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য শর্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে: “যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর জন্য মুহাব্বত করলো, আল্লাহর জন্য শত্রুতা করলো, আল্লাহর জন্য কাউকে কিছু দান করলো এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে বিরত রাখলো, সে তার ঈমানকেই পূর্ণ করে নিলো।”

মানুষের জীবনে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা বাস্তবিকই অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তাই ঈমানের পূর্ণতার জন্য এ দুটো জিনিসকেই আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়ার অপরিহার্য শর্ত নিতান্ত স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত হয়েছে। ঈমানের বহুতর শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর প্রতিটি শাখায় নিজ নিজ জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুসংহত শক্তিকে ক্ষমতাসীন করার জন্য আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা যেরূপ জরুরি তার পরিপ্রেক্ষিতে নবী করিম (সা:) তাকে সমস্ত কাজের চাইতে শ্রেষ্ঠ কাজ বলে অভিহিত করেছেন। হযরত আবুজার (রা:) বর্ণনা করেন: “একদা রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাদের কাছে আগমন করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান, আল্লাহ তায়ালার কাছে কোন কাজটি বেশি প্রিয়? কেউ বললো নামাজ ও জাকাত। কেউ বললো জিহাদ। মহানবী (সা:) বললেন, কেবল আল্লাহর জন্য মুহাব্বত এবং আল্লাহর জন্যই শত্রুতাই হচ্ছে সমস্ত কাজের মধ্যে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।” (আহমদ, আবু দাউদ, আবু যাররা) আর একবার হযরত আবুজার (রা:)কে উদ্দেশ করে রাসূল (সা:) প্রশ্ন করেন : ‘হে আবুজার! ঈমানের কোন্ কাজটি অধিকতর মজবুত? জবাব দিলেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। মহানবী (সা:) বললেন: তা হচ্ছে আল্লাহর পথে বন্ধুত্ব এবং তাঁর জন্য ভালোবাসা ও শত্রুতা।’ (বায়হাকি-ইবনে আব্বাস) বানু ফিহ্রের মুসতাওরিদ (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন- দুনিয়া আখিরাতের তুলনায় এতটুকু, যেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রের পানিতে তার একটি আঙুল ডুবিয়ে তুলে আনল। সে দেখুক তার আঙুল কতটুকু পানি নিয়ে ফিরেছে। (জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২৩২৩)

আখিরাতে ভ্রাতৃত্বের সুফল
দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর জন্য মুহাব্বতের ফলাফল তো আছেই; কিন্তু আখিরাতে যখন মানুষের প্রতিটি নেক কাজই মূল্যবান বিবেচিত হবে এবং একটি মাত্র খেজুরের সাদকা ও একটি ভালো কথাও তার জন্য গনিমত বলে সাব্যস্ত হবে, তখন এ সম্পর্ক একজন মুমিনকে অত্যন্ত উঁচু মর্যাদায় অভিষিক্ত করবে। বস্তুত ইসলামী বিপ্লবের ব্যাপারে সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানি, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুবই স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। সেদিন অন্যের সম্পর্কে কারো কোন হুঁশ থাকবে না। মানুষ তার মা-বাপ, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা সবকিছু ছেড়ে দূরে পালিয়ে যাবে। জাহান্নাম থেকে বাঁচবার জন্য তাদের সবাইকে বিনিময় দিতেও সে তৈরি হবে। সেদিন বন্ধুত্বের তামাম রহস্য উদঘাটিত হয়ে যাবে এবং দুনিয়ার জীবনে যাদের ভালোবাসা দিল ও দিমাগে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিলো, সে বন্ধুই সেখানে শত্রুতে পরিণত হবে। কিন্তু প্রকৃত খোদাভীরু লোকদের বন্ধুত্ব সেখানে বজায় থাকবে। এজন্য যে, সেদিন কাজে লাগবার মতো কি জিনিস সে বন্ধুরা দুনিয়ার জীবনে পরস্পরকে দান করেছে, সেই সঙ্কট মুহূর্তে তা নির্ভুলভাবে জানা যাবে এবং তার গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুভূত হবে: ‘যারা পরস্পরের বন্ধু ছিল, সেদিন পরস্পরের শত্রু হয়ে যাবে, কেবল মুত্তাকি লোক ছাড়া। হে আমার বান্দাহ্গণ! আজকে তোমাদের কোন ভয় নেই, তোমরা ভীত সন্ত্রস্তও হবে না।’ (সূরা যুখরূফ : ৬৭-৬৯)

পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান
মুসলমানরা পরস্পরের মান-ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান, দুঃখ-কষ্টে অংশগ্রহণ, গঠনমূলক সমালোচনা, উপদেশ-নসিহত, একত্রে বসবাসসহ সার্বিক বিষয়ে পরস্পরের সহযোগী হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের পরিবেশ তৈরিতে ভ্রাতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। রাসূল (সা:) বলেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বান্দার সাহায্য করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।’ (সহিহ মুসলিম) এ ছাড়াও দুনিয়াবি ক্ষণস্থায়ী জীবনে স্বার্থপরতার মূলোৎপাটন, সর্বদা ভোগের বিপরীতে ত্যাগের মনোভাব তৈরি করার মধ্য দিয়ে পরকালীন জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথ সুগম করাই ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মূল উদ্দেশ্য। উল্লিখিত উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক তথা ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির বিষয়ে মহান আল্লাহ এবং রাসূল (সা:) মুসলিম সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। নিম্নে তার যৎসামান্য উপস্থাপন করা হলো।

নোমান বিন বাশির (রা:) বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন, “তুমি ঈমানদারদেরকে তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, বন্ধুত্ব ও দয়া-অনুগ্রহের ক্ষেত্রে একটি দেহের ন্যায় দেখবে। যখন দেহের কোনো অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন সমস্ত শরীর তজ্জন্য বিনিদ্র ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) অন্য হাদিসে নোমান বিন বাশির (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা:) বলেছেন, “সকল মুমিন এক ব্যক্তির মত। যদি তার চক্ষু অসুস্থ হয়, তখন তার সর্বাঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর যদি তার মাথায় ব্যথা হয়, তখন তার সমস্ত দেহই ব্যথিত হয়।” (সহিহ মুসলিম) আবু মূসা আশআরী (রা:) হতে বর্ণিত, নবী (সা:) বলেছেন “একজন মুমিন আর একজন মুমিনের জন্য এক গৃহের মত, যার একাংশ অপরাংশকে সুদৃঢ় রাখে। অতঃপর তিনি এক হাতের আঙুলগুলো অপর হাতের অঙ্গুলির মধ্যে প্রবিষ্ট করালেন।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) উল্লিখিত তিনটি হাদিসে মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সুদৃঢ় অবস্থানের স্পষ্ট বর্ণনা ফুটে উঠেছে। দেহের প্রতিটি অঙ্গের স্বতন্ত্র অবস্থান ও কর্মপরিধি থাকলেও বিপদে যেমন পরস্পরের প্রতি সহমর্মী-সমব্যথী, তেমনি বর্ণে, বংশে, কর্মক্ষেত্রে বা ভৌগোলিক অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে বিশ্বের সকল মুসলমান একটি অখণ্ড শরীরের মত। মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতার কথা হাদিসে বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে।

আনাস (রা:) বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন, “তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, চাই সে অত্যাচারী হোক বা অত্যাচারিত হোক। তখন এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অত্যাচারিতকে তো সাহায্য করব; কিন্তু অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করব? তখন নবী করীম (সা:) বললেন, তাকে অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখবে। এটিই তাকে তোমার সাহায্য করার নামান্তর।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

পারস্পরিক সহযোগিতার পুরস্কার সম্পর্কে রাসূল (সা:) এরশাদ করেছেন, “এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তাআলা তার অভাব মোচনে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহের কোন একটি বড় বিপদ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) অন্য হাদিসে রাসূল (সা:) বলেন, “এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। কাজেই সে তার ওপর জুলুম করবে না, তাকে লজ্জিত করবে না এবং তাকে হীন মনে করবে না। ‘তাকওয়া’ (আল্লাহভীতি) এখানে এ কথা বলে তিনি তিনবার নিজের বক্ষের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তিনি আরো বলেন, কোন ব্যক্তির মন্দ কাজ করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে নিজের কোন মুসলমান ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। বস্তুত একজন মুসলমানের সব কিছুই অপর মুসলমানের জন্য হারাম। তার জান, মাল ও ইজ্জত।” (সহিহ মুসলিম)

পারস্পরিক কল্যাণ কামনা
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আর একটি উদ্দেশ্য হলো পারস্পরিক কল্যাণ কামনা করা। পারস্পরিক কল্যাণ কামনার বিষয়ে নবী করীম (সা:) বলেন, “দ্বীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা।” (সহিহ মুসলিম) বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি কথাটি তিন বার উল্লেখ করেন।
জারির ইবনু আবদুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, “আমি রাসূল (সা:) এর হাতে সালাত আদায়, জাকাত প্রদান এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করার অঙ্গীকার করে বায়আত করলাম।” (সহিহ মুসলিম) আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন, “একজন মুমিনের ওপরে আরেক মুমিনের ছয়টি কর্তব্য রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো যখন সে তোমার কাছে পরামর্শ চাইবে, তখন তুমি তাকে (কল্যাণকর) উপদেশ দিবে।” (সহিহ মুসলিম) অন্য একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে বলা হয়েছে, “এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো উপস্থিত বা অনুপস্থিত উভয় অবস্থায় তার কল্যাণ কামনা করবে।” (সুনানে নাসাই) মানুষ তার দ্বীনি ভাইয়ের কল্যাণ কামনায় সর্বদা উদগ্রীব থাকবে। তারই মঙ্গল সাধনে সর্বতোভাবে চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। তার কোনো ক্ষতি হোক এমন কোন বিষয় তার দ্বারা সংঘটিত হবে না। অথচ সমাজে দেখা যায়, এক শ্রেণির মানুষ তার দ্বীনি ভাইয়ের কল্যাণ কামনার পরিবর্তে তার ক্ষতি করার জন্য সর্বদা সময়, শ্রম, মেধা ও বুদ্ধি অপচয় করে থাকে। প্রতিনিয়ত নানা কূটকৌশল ও চক্রান্তের জাল বিস্তার করে। একটি কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে নতুন ফন্দি আঁটে। “বাহ্যিকভাবে তারা মানুষের কাছে ভালো হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোক। এ জাতীয় লোককে আল্লাহ পছন্দ করেন না; বরং তিনি প্রকৃত ‘মুহসিন’ বান্দাকে পছন্দ করেন।” (সূরা আল বাকারা : ১৯৫) আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয় ছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে যার মাধ্যমে পারস্পরিক মুহাব্বত বৃদ্ধি পাবে, সম্পর্ক অটুট থাকবে, সাথে সাথে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

মুহাব্বত ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির উপায়
ইসলামী শরিআতে মুমিনের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির বিভিন্ন নিয়ামকের বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে সেসব কর্ম ও আচরণ গ্রহণ ও অনুসরণ করলে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় ও স্থায়ী হয়, বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং এর ফলে দু’টি হৃদয় সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঘনিষ্ঠতর ও মজবুত হয়। এক্ষেত্রে শরিআতের কিছু আহকাম আছে আবশ্যকীয় এবং কিছু আছে ইচ্ছাধীন। তবে পারস্পরিক মুহাব্বত ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিকশিত ও ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্য উভয়েরই গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

নিম্নে ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির কতিপয় নিয়ামক সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
সালাম প্রদান: মুমিনজীবনে সালামের গুরুত্ব অপরিসীম। আদম (আ)-কে সৃষ্টি করে তার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম যে নির্দেশ প্রদান করা হয়, তা হলো ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে সালাম প্রদান। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) সালামের বহুমুখী দিক রয়েছে। যেমন সালামের ফজিলত, সালাম প্রদানকারী অহঙ্কার হতে মুক্ত, সালাম প্রদান করা হক ও সালাম না দেয়া কৃপণতা ইত্যাদি। এ ছাড়াও এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সালাম প্রদানের মাধ্যমে পারস্পরিক মুহাব্বত বৃদ্ধি পায়। কারণ সালামের অর্থই হলো দ্বীনি ভাইয়ের প্রতি শান্তি, রহমত ও বরকত প্রার্থনা করা। সালামের মাধ্যমে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি প্রসঙ্গে নিম্নের হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য।

আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন, “তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে। আর তোমরা ঈমানদার হিসাবে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে মুহাব্বত করবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কথা বলে দেবো না যা তোমাদের পারস্পরিক মুহাব্বত বৃদ্ধি করবে? (আর তা হচ্ছে) তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করবে।” (সহিহ মুসলিম) নবী করীম (সা:) যখন রাস্তায় চলতেন, তখন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে যার সঙ্গেই তার দেখা হতো, তাকে তিনি সালাম দিতেন। আমাদেরকেও রাসূল (সা:)-এর অনুসরণে মুসলিম নারী-পুরুষ শিশু-বৃদ্ধ সকলকে সালাম প্রদান করতে হবে। এতে সকলের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে, পারস্পরিক মুহাব্বাত বৃদ্ধি পাবে। তবে সালামের আদান-প্রদান যখন সঠিক অনুভূতি নিয়ে করা হবে অর্থাৎ এক ভাই অপর ভাইকে শান্তির জন্য দুআ করবে এবং এর মাধ্যমে তার হৃদয়ে মুহাব্বাত ও শুভ কামনার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, কেবল তখনই সালামের মাধ্যমে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পাবে। অন্যথা প্রচলিত অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে শুধু মুখে তোতা পাখির মত দু’টি আরবি শব্দ নিঃসৃত হলে সালামের হক আদায় হতে পারে, কিন্তু তাতে পারস্পরিক মুহাব্বত বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

মুসাফাহা করা: সালামের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয় হলো মুসাফাহা। যার অর্থ পরস্পর হাত মিলানো বা করমর্দন করা। কদমবুসি বা পদচুম্বন ইসলামী শরিআতে বৈধ না হলেও মুসাফাহা এবং মুআ’নাকা তথা কোলাকুলি বৈধ। যেমন হাদিসে এসেছে, কাতাদা (রা:) বলেন, আমি আনাস (রা:)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূল (সা:)-এর সাহাবিগণের মধ্যে মুসাফাহার প্রচলন ছিল কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, ছিল।’ (সহিহ বুখারি) মুসলমানদের পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ হলে সালাম বিনিময়ের পর হৃদয়ের গভীরে আন্তরিকতার যে প্রগাঢ় আবেগ নিহিত থাকে, সেই প্রেরণা থেকেই আপসে করমর্দন করে থাকে। এর মাধ্যমে যেমন বন্ধুত্ব সুসংহত হয়, তেমনি উভয়ের গোনাহ মাফ হয়। রাসূল (সা:) বলেন, “যখন দু’জন মুসলমানের পরস্পর সাক্ষাৎ হয় এবং তারা মুসাফাহা করে, পৃথক হওয়ার পূর্বেই তাদের উভয়ের গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (তিরমিজি শরিফ) তাই পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃত গোনাহ হতে পরিত্রাণ লাভের সহজ ও সুন্দর মাধ্যম হিসেবে মুমিনজীবনে বেশি বেশি সালাম ও মুসাফাহার প্রচলন করা উচিত।

উপহার প্রদান: উপহার প্রদান ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির একটি অন্যতম নিয়ামক। প্রকৃতপক্ষে ভালো কথা বলা, উৎকৃষ্ট আচরণ করা, সৎ পরামর্শ প্রদান ইত্যাদিও এক ধরনের উপহার। এর মাধ্যমে একজন মানুষ অতি সহজেই অন্যের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে তার সাথে যোগসূত্র রচনা করতে পারে। তেমনি বস্তুগত উপহারের মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক মুহাব্বত ও বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পায়। উপহার প্রদানে উৎসাহিত করে রাসূল (সা:) যেমন উপদেশ দিয়েছেন, তেমনি উপহার প্রদানের উপকারিতাও বর্ণনা করেছেন। যেমন- তিনি বলেন, “তোমরা একে অপরকে উপহার পাঠাও, এর দ্বারা পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।” (আল আদাবুল মুফরাদ, সহিহ সনদ) আনাস (রা:) বলতেন, “হে বৎসগণ! তোমরা একে অপরের জন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করবে, এতে তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে।” (আল আদাবুল মুফরাদ, সহিহ সনদ) রাসূল (সা:) নিজে যেমন তাঁর সঙ্গী-সাথীদের উপহার দিতেন, তেমনি সাহাবিগণও তাঁকে ও অন্য সাহাবিদেরকে উপহার প্রদান করতেন।

হাসিমুখে কথা বলা: হাসিমুখে কথা বলার মাধ্যমে অতি সহজেই অন্যের মন জয় করা সম্ভব। তা ছাড়া কর্কষভাষী বা কঠিন হৃদয়ের মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। মহান আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলে। যদি তুমি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের লোক হতে, তবে তোমার নিকট থেকে তারা দূরে সরে যেত। (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯) অনুরূপভাবে মিষ্টি হেসে কথা বলাকে রাসূল (সা:) সাদাকা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (তিরমিজি শরিফ) তা ছাড়া ভালো ও সুন্দর কথা পরকালে জাহান্নামের শাস্তি থেকে আত্মরক্ষায় সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। রাসূল (সা:) এরশাদ করেন, “জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর। যদিও তা অর্ধেক খেজুরের বিনিময়েও হয়। যে তাও দান করতে অক্ষম, সে লোকজনকে ভালো ও সুন্দর কথা দ্বারা জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করবে।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) অন্যত্র তিনি আরো বলেন, “ভালো কথাও সাদাকা হিসাবে গণ্য হবে।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

পরিশেষে, সাতজন ব্যক্তি যারা আল্লাহর ছায়ায় থাকবে, তাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিও থাকবে যারা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে মুহাব্বত করে এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তা বজায় রাখে। কোন মুসলিম ভাইকে আল্লাহর জন্য মুহাব্বত করলে তাকে তা জানিয়ে দিতে হবে। ইহকালীন সফলতা ও পরকালে মুক্তির জন্য পারস্পরিক মুহাব্বতের এ গুরুত্ব অত্যন্ত অপরিসীম।

মন্তব্য