প্রত্যাশা প্রাপ্তির মেলবন্ধনের চার দশক
বাঙালি মুসলমানের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস বহু প্রজন্মের লড়াইয়ের সামষ্টিক হিসাব মাত্র। বহু প্রজন্মের এই সংগ্রামকে নিকটবর্তী দুই কিংবা তিন প্রজন্মের ইতিহাস হিসেবে চালিয়ে দেয়া এক হীন রাজনৈতিক প্রতারণা বৈ আর কিছুই নয়। একটি নির্দিষ্ট ও সংক্ষিপ্ত সময়ের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাস কিংবা ঐতিহাসিক সংগ্রামের চেতনাকে সীমাবদ্ধ করার মুখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে বাংলাদেশকে জাতিগতভাবে বিভক্ত করা। অথচ নানান সমস্যায় জর্জরিত এই দেশের মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই বারবার ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধিকারের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বাঙালি মুসলমানের হাত ধরেই সর্বপ্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিম ভারতে দুর্নিবার ওয়াহাবি আন্দোলন (১৭৮৬-১৮১৩ খ্রি:), তিতুমীরের নেতৃত্বে মুসলিম সাধারণ সমাজের বিশেষ করে রায়তের অধিকার আদায়ের আন্দোলন (১৮৩০-৩২), প্রায় একই সময়ে হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন এবং ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা রক্তক্ষয়ী সিপাহি বিদ্রোহসহ (১৮৫৭) সকল আন্দোলন ও সংগ্রামের লক্ষ্য ছিলো বাংলার সাধারণ মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা।
এরপর বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ও বঙ্গভঙ্গরদ (১৯১১), ভারত-পাকিস্তান নামে পৃথক রাষ্ট্রগঠনও (১৯৪৭) এদেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি এবং প্রকৃত স্বাধীনতা দিতে পারেনি। আবারো ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেয় এদেশের সাধারণ জনগণ। কিন্তু যে প্রত্যাশায় সংঘটিত হয়েছিল এসব আন্দোলন সংগ্রাম, স্বাধীনতার চার দশক পরও সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে ওঠেনি আজও। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এখনও অধরাই রয়ে গেছে। গণতন্ত্র রয়ে গেছে কার্যত তাত্ত্বিক পর্যায়ে। সুশাসন তো দূরের কথা, প্রচলিত আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। আর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, জবর দখলসহ নানান সব নেতিবাচক দিকই ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত হলেও তার বিকাশ রুদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের প্রকৃত দায়িত্ব পালনে যথাযথ ভূমিকা রাখছে না। কৃষক তাদের উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। মেধাবীদের মেধার যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না বরং দলীয় লেজুড়বৃত্তি বেড়ে চলেছে ক্রমশ। মাদকদ্রব্য ও নেশাজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ফলে মূল্যবোধ ও নীতির সর্বগ্রাসী অবক্ষয় তরুণ সমাজকে বিপথগামী করছে। বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতির সামনে।
এই চ্যালেঞ্জ তারাই মোকাবেলা করতে পারবে ইচ্ছাশক্তি যাদের সূর্যের মত প্রখর, বিশ্বাস যাদের পাহাড়ের মতো অটল। বহু গুণে গুণান্বিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অগ্রসেনানী। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে গড়ে তোলার জন্য সৎ ও যোগ্য লোক তৈরির কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। ছিল না দেশ পরিচালনার কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য। ছাত্ররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ হলেও তাদেরকে দেশগঠনের উপযোগী করে তোলার কোন পথ তখন ছিল না। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠা তাই ছিল তৎকালীন সময়ের এক অনিবার্য দাবি। এমতাবস্থায় দেশগঠনের জন্য সৎ, যোগ্য, মেধাবী, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের বিকাশে এবং ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের মহান ও পবিত্র লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। শুরু হয় এক ঐতিহাসিক পথপরিক্রমার। যেটা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ জাতির জন্য সুখবরের বার্তা বয়ে আনে।
আল্লাহর এ জমিনে সকল প্রকার জুলুম ও নির্যাতনের মূলোচ্ছেদ করে আল কুরআন ও আল হাদিসের আলোকে ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের সৌধের ওপর এক আদর্শ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার মহান ও পবিত্র লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসলাম অর্থ শান্তি আর শিবির অর্থ তাঁবু; প্রকৃত অর্থে ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছাত্রদের তাঁবু বা ঘাঁটি হচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির। ছাত্রশিবির আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার এক অপ্রতিরোধ্য কাফেলার নাম। সৎ, যোগ্য ও খোদাভীরু নেতৃত্বের উৎসস্থল হচ্ছে ছাত্রশিবির। অন্যায়, অসত্য ও জীর্ণতার বিরুদ্ধে শিবির হচ্ছে একটি চলমান সাইক্লোন। বিজয়ের জয়গান গায় ছাত্রশিবির। মেধাবী ছাত্রদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান এ সংগঠন। নতুন আবিষ্কারে উদ্বেল তারুণ্যের উৎসাহ ছাত্রশিবির। যেখানে মেধা, মননশীলতা আর মূল্যেবোধের জয়গান সেখানেই ছাত্রশিবির।
যাত্রার শুরু থেকেই ছাত্রশিবিরকে থামিয়ে দেয়ার জন্য চক্রান্ত শুরু হয়। ইসলামবিরোধী শক্তি ছাত্রশিবিরের এ আত্মপ্রকাশকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ছাত্রশিবিরের ওপর চালিয়েছে অত্যাচার, অবিচার, জেল, জুলুম, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, অপপ্রচার ও হত্যাযজ্ঞ। কোনোভাবেই তারা ছাত্রশিবিরকে এগোতে দিতে চায়নি। তাদের সন্ত্রাসের কারণে ২৩৪ জন শিবিরকর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে; আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে শত শত কর্মীর। সকল ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে গাঢ় তমসার পথ চিরে চিরে আল্লাহর অশেষ রহমতে ছাত্রশিবির আজ এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ছাত্রশিবির আজ একটি আন্দোলনের নাম। ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রসমাজের বিপ্লবের স্পন্দন। আগুনঝরা বারুদের পল্লবিত বৃক্ষের নাম ছাত্রশিবির। অসংখ্য মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, ভালোবাসা, প্রত্যাশা, স্বপ্ন আজ শুধুই ছাত্রশিবিরকে কেন্দ্র করে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার প্রতিটি জনপদ, নদী-খাল-বিল, উপত্যকায় আজ ছাত্রশিবিরের জয়গান- ‘পদ্মা, মেঘনা, যমুনার তীরে আমরা শিবির গড়েছি।’
বাংলাদেশের বৃহত্তম সংগঠিত ছাত্রসংগঠন- বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। ৪০ বছরের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে শিবির আজ এক দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মতোই বিকশিত সংগঠন। ইসলামবিরোধী শক্তির হাজারো বাধা-বিপত্তি, ক্ষমতাসীনদের ক্রমাগত নির্যাতন নিষ্পেষণ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্রিয়াশীল, সৃজনশীল ও জাতিগঠনমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে এর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ছাত্ররাজনীতিতে শিবির ইতিবাচক, গঠনমূলক ও সুষ্ঠু ধারার ছাত্ররাজনীতির প্রবর্তক। সর্বোপরি ইসলামী ছাত্রশিবির একটি একক ও অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোন প্রতিক্রিয়াশীল, ষড়যন্ত্রকারী ও দমনমূলক কার্যক্রম এই সংগঠনের গতিশীলতাকে রুখতে পারেনি এবং পারবেও না ইনশাআল্লাহ। ছাত্রশিবির সাধারণ ছাত্র-জনতার মনের গহিনে স্থান করে নিয়েছে- পছন্দে, ভালোবাসায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির একটি অন্যতম মানবসম্পদ সংগঠন (Human Resource Organization),একটি অন্যতম ক্রিয়াশীল জনগোষ্ঠী (Proactive Human Group), একটি গতিশীল ছাত্রসংগঠন (Enviable Progressive Student Organization), একটি ব্যতিক্রমী নৈতিক যুবগোষ্ঠী (Special Kind of Moral Force) এবং সর্বোপরি উন্নত বাংলাদেশের প্রতিশ্রুত নেতৃত্ব সরবরাহের কারখানা (Leadership Supply Chain for a Developed Bangladesh)|
আল্লাহ প্রদত্ত রাসূল (সা)-এর নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনকে লক্ষ্য উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে ছাত্রশিবির। এ লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য শিবিরের রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত পাঁচ দফা কর্মসূচি। অন্যতম কর্মসূচি হলো তরুণ ছাত্রসমাজের মাঝে ইসলামের সুমহান আহবান পৌঁছে দেয়া। যেসব ছাত্র এ আহবানে ঐকমত্য পোষণ করে তাদেরকে সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করা। সংগঠনের আওতাধীন ছাত্রদেরকে তানজিম ও তরবিয়াতের মাধ্যমে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে দৃঢ় করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখা। গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করা। দেশ-জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করা, যারা পরিবার, সমাজ ও দেশ-জাতির জন্য রাহবার হিসেবে কাজ করবে। যারা হতাশার তিমিরেও আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করবে। ছাত্রশিবির মেধাবী ছাত্রদেরকে সত্য ও সুন্দরের সহযাত্রী হতে অনুপ্রাণিত করতে মেধাবী সংবর্ধনা, ক্যারিয়ার গাইডলাইন প্রোগ্রাম, গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য স্টাইপেন্ড চালুর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর সপ্তাহ ও পক্ষকাল ব্যাপী ‘পরীক্ষায় নকল’, মাদক ও ইভটিজিং বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে থাকে। এছাড়াও বিনামূল্যে গরিব-মেধাবী ছাত্রদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, ব্লাড ডোনেশন, ব্লাড গ্রুপিং, ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প, পথশিশুদের জন্য ভ্রাম্যমাণ শিক্ষাকার্যক্রম চালু, কুরআন প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, উন্মুক্ত জলাশয়ে ও নদী-নালায় মাছের পোনা ছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা সমগ্র দেশবাসীর কাছে অনন্য বিস্ময়! বিশেষ করে জাতির ক্রান্তিলগ্নে সকল স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সংক্ষিপ্ত আকারে শিবিরের কার্যক্রমের প্রতিচ্ছবি দেখলেই শিবিরের কাজের ধারাবাহিকতার ব্যাপারে ধারণা স্পষ্ট করা সম্ভব।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসমাজের অধিকার ও দাবি-দাওয়া আদায়ের প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। কাগজ-কলম- খাতাসহ শিক্ষা উপকরণের দাবিতে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে বহু কর্মসূচি পালন করে শিবির। শিবির প্রতিনিয়ত ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রশিবির ছাত্রসংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে সেখানেই শিবির আরো বেশি ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ঠিকানায় পরিণত হয়েছে।
প্রতি বছর ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে ১৫ আগস্টকে “ইসলামী শিক্ষা দিবস” হিসেবে পালন করে থাকে ছাত্রশিবির। ২০০২ সালে দেশব্যাপী শিক্ষা সপ্তাহ পালন করা হয় শিবিরের উদ্যোগে। এ উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় বিজ্ঞানমেলা, জাতীয় সেমিনার, বিজ্ঞানমেলা, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, মেধাবী ছাত্রদের সমাবেশে শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি প্রশ্নোত্তর, শিক্ষাসামগ্রী প্রদর্শন, Understanding Science Series প্রদর্শনী এবং “আমাদের শিক্ষাসঙ্কট : উত্তরণের উপায়” শীর্ষক বুকলেট প্রকাশসহ বহুবিধ প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়।
শিক্ষা নিয়ে যেকোনো ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করেছে ছাত্রশিবির। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে। শিক্ষাখাতে যে ব্যয়-বরাদ্দ দেয়া উচিত অনেক সময়েই তা দেয়া হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে অনৈসলামিক উপাদানের প্রবেশ, দেরিতে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, দলীয়করণ, ইতিহাস বিকৃতি ও জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ধুয়া তুলে বিভক্ত করার গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শিবির সবসময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। মিছিল, মিটিং, ছাত্রধর্মঘট, সমাবেশ বিক্ষোভ, ঘেরাও, লিফলেট, প্রচারপত্র বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে ভূমিকা পালন করেছে সংগঠন। বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা বরাবরই অবহেলিত। সাধারণ প্রতিষ্ঠান ও মাদরাসার মধ্যে বিরাট ব্যবধান করে রাখা হয়েছে সবসময়। শিবির তার জন্মলগ্ন থেকেই মাদরাসার এ বৈষম্য দূর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সৃজনশীল প্রকাশনায় শিবির সবসময়ই অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সমৃদ্ধ প্রকাশনা বিভাগ আধুনিক রুচিসম্মত এবং সামাজিক চাহিদানির্ভর বিভিন্ন প্রকাশনা সামগ্রী প্রকাশ করে থাকে নিয়মিত। তথ্যবহুল দাওয়াতি কার্যক্রম, উপহার আদান-প্রদান এবং সুস্থ বিনোদন চর্চায় শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী অনন্য। এই প্রকাশনা সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- নববর্ষের ছয় প্রকার ক্যালেন্ডার, চার প্রকার ডায়েরি, অসংখ্য ক্যাসেট এবং বহু রকমের কার্ড, ভিউকার্ড, স্টিকার, মনোগ্রাম, কোটপিন, চাবির রিং, চিঠির প্যাড ইত্যাদি প্রকাশনীর মাধ্যমে ছাত্রসমাজের মাঝে একটি সাড়া জাগিয়েছে। শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী সর্বস্তরের মানুষের কাছে একটি অকৃত্রিম সৌন্দর্যের প্রতীক। তথ্যবহুল, গবেষণালব্ধ, বহু রঙ ও ডিজাইনের ক্যালেন্ডার, ডায়েরি দেশ ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
বিজ্ঞানসামগ্রী প্রকাশনায়ও ছাত্রশিবির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিতভাবে। দেশে বিজ্ঞানশিক্ষার পশ্চাৎপদতা দূর করার জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকাশ করেছে পদার্থ, রসায়ন ও জীববিদ্যার ওপর রেফারেন্স বই ও চার্ট পেপার। এ বইগুলো এসএসসি/দাখিল, এইচএসসি/আলিম ও ডিগ্রির প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনন্য ও অপরিহার্য শিক্ষাসহযোগী উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ, প্রয়োজন এবং অ্যাকাডেমিক শিক্ষার যথার্থ তথ্য উপকরণ দিয়েই এই Understanding Science Series প্রকাশিত হয়েছে।
সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছাত্রশিবিরের রয়েছে এক সম্ভাবনাময়ী পদচারণা। একটি দেশের রাজনৈতিক বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এ দেশের ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে শিবিরের রয়েছে নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। জ্ঞানার্জন ও মেধা বিকাশের পাশাপাশি একজন ছাত্রকে মানসিক বিকাশের জন্য এবং তার মধ্যে সহজভাবে ইসলামের জীবনপদ্ধতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরার জন্য রয়েছে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অপসংস্কৃতির সয়লাব থেকে ছাত্র ও যুবসমাজকে রক্ষা করে তাদেরকে ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে হলেও প্রয়োজন পরিশীলিত সংস্কৃতির আয়োজন। সাহিত্য-সংস্কৃতি মানেই অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, পাশ্চাত্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্ধ অনুকরণ- এই ধারণার পরিবর্তন করতে শিবির বদ্ধপরিকর। ইসলামী ছাত্রশিবির সে জন্যই ইসলামী সংস্কৃতির এক বিরাট জগৎকে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশে ইসলামী সংস্কৃতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
ছাত্রকল্যাণমূলক কার্যক্রম ছাত্রশিবিরের মৌলিক কর্মসূচির অংশ। ছাত্রদের কল্যাণমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় শিবির সদাতৎপর। বাড়ি থেকে দূরে অবস্থানকারী ছাত্রদেরকে লজিংয়ের ব্যবস্থা করে দেয়া, বেতন দানে অক্ষম ছাত্রদেরকে বেতন প্রদান, বইক্রয়ে সহযোগিতাসহ, মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, ফ্রি কোচিং, বিনামূল্যে প্রশ্নপত্র বিলি এবং কর্জে হাসানা প্রদান করে থাকে।
ছাত্রদের অ্যাকাডেমিক বইয়ের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার জন্য শিবির প্রতিষ্ঠা করে থাকে লেন্ডিং লাইব্রেরি। শিবির তার কর্মীদেরকে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই তার বই শিবির পরিরচালিত লেন্ডিং লাইব্রেরিতে বিনামূল্যে প্রদান করতে উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিবির বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্লাসের বই লেন্ডিং লাইব্রেরির জন্য সংগ্রহ করে থাকে। ফেরত দেয়ার শর্তে বই গরিব ও উপযুক্ত ছাত্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেখানে ছাত্রসমাজের কল্যাণমুখী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য ছাত্রশিবির এসব নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সৃজনশীল ও গঠনমূলক নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয় ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী ছাত্রসংগঠনগুলো। তাই প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ছাত্রসমাজের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে ছাত্রশিবির। এরই প্রতিফলন ঘটে দেশের খ্যাতনামা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ছাত্রশিবির ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ১৯৮০ সালে খুলনা আজম খান কমার্স কলেজে ভিপি, জিএস, এজিএস পদে, ১৯৮১ সালে হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজে এবং একই বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসগুলোতে অনুষ্ঠিত ছাত্রসংসদ নির্বাচনে শিবির অংশ নিয়েছে এবং আল্লাহর রহমতে পূর্ণ বা আংশিক প্যানেলে বিজয় অর্জন করেছে এবং ছাত্রসমাজের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমানতদারিতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছে।
সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে সদা তৎপর থেকেছে ছাত্রশিবির। সঙ্কট ও দুর্যোগ মুহূর্তে ত্রাণ বিতরণ, উদ্ধারকাজ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, শীতবস্ত্র বিতরণ বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বাঁধ নির্মাণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, রক্ত দান ও ব্লাড গ্রুপিংসহ নানাবিধ সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে শিবির সাধারণ ছাত্র-জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে সমাজসচেতন করে গড়ে তোলা, সামাজিক দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিবির সে কাজটি প্রতিনিয়তই করে থাকে।
শিবিরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ জান্নাতি পরিবেশ। এদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্ত্রের ঝনঝনানি, সন্ত্রাস, ছিনতাই, সংঘাত, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি নিত্যনৈমিত্তিক ঘঢনায় পরিণত হয়েছে। অশ্লীলতা, বেহায়াপনার সয়লাবে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছাত্রসমাজ। ফেনসিডিল, হেরোইন ইত্যাদি নেশাজাত দ্রব্য নতুন প্রজন্মকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একজন ছাত্র আর একজন ছাত্রকে আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করে না। আল্লাহর মেহেরবানিতে নৈতিক অবক্ষয়ের এ প্রচণ্ড ধাক্কা শিবিরকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনও। শিবিরের একজন কর্মী নিজেদের হাতে নিহত হয়েছে এমন কোনো ঘটনা কল্পনাও করা যায় না; কোন কর্মী অন্য কর্মীর গায়ে হাত দিয়েছে এমন কোনো ঘটনাও নেই। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীদের মাঝে রয়েছে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস, প্রেরণা ও উৎসাহ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তদুপরি নিঃস্বার্থভাবে অপরের জন্য ত্যাগী মনোভাব ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক পরিবেশকে উচ্চ শিখরে উন্নীত করেছে।
ছাত্রশিবিরে প্রতিটি কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহির চেতনা থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও দায়িত্ব পালনে ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের কাছে জবাবদিহি করার ব্যবস্থা আছে। সংগঠনের জনশক্তি, সম্পদ, সংগঠনের মর্যাদা ইত্যাদি আমানত। সে আমানতের খেয়ানত যেন না হয় সে জন্য দায়িত্বশীলগণও জবাবদিহির চেতনা নিয়েই দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
যে কোনো সংগঠন, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের গতিশীলতার জন্য Chain of leadership অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জন্মলগ্ন থেকেই শিবির এক্ষেত্রে যথাযথ নজর দিয়ে আসছে। প্রতি বছরই নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচন ও সেক্রেটারি জেনারেল মনোনয়ন সম্পন্ন হয়। এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের ইউনিটগুলোতেও এসময় প্রতি বছর কমিটি গঠন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ইসলামী ছাত্রশিবির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
যুবসমাজের সৃজনশীল প্রতিভাব বিকাশে ও সাহিত্যমোদী ছাত্রদেরকে সংগঠিত করে লেখক শিবির গঠন করা হয়। সাহিত্য আসর, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাময়িকী, দেয়ালিকা, পত্রিকা, স্মরণিকা ও সঙ্কলন প্রকাশের মাধ্যমে লেখার যোগ্যতা বৃদ্ধিতে শিবিরের কর্মসূচি রয়েছে। জনশক্তির উন্নত নৈতিক মান নিশ্চিত করা শিবিরের অন্যতম কার্যক্রম। শিবিরকর্মীদের নৈতিক ও গুণগত দিক থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন করার জন্য রয়েছে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা, ইসলামী সাহিত্য পাঠ ও বিতরণ, পাঠচক্র, আলোচনা চক্র, সামষ্টিক অধ্যয়ন, শিক্ষা শিবির, শিক্ষা বৈঠক, শববেদারি বা নৈশ ইবাদাত, ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ, দোয়া ও নফল ইবাদাত, গঠনমূলক সমালোচনা, আত্মসমালোচনা, কুরআন তালিম, কুরআন ক্লাস ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি।
নেতৃত্ব ও আনুগত্যের ভারসাম্য ইসলামী সংগঠনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি ইসলামী ছাত্রশিবির অনুসরণ করে থাকে। অন্ধ আনুগত্য নয় বরং সৎকর্মের ক্ষেত্রে আনুগত্য। ব্যক্তির পরিবর্তনে আনুগত্যের পরিবর্তন এখানে হয় না। নেতৃত্বের ও জনশক্তির প্রতি কর্মীদের রহমদিল ভালোবাসা বিরাজিত থাকবে। নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সমন্বয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সভা, সম্মেলন, সেমিনারে অন্যতম বৃহৎ ইসলামী ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের সঙ্কট নিরসনে আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশে শিবিরের প্রতিনিধি উপস্থিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। WAMY, IIFSO, AFMY, IYFO সহ আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহে ছাত্রশিবির প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তি প্রমাণ করে যে ছাত্রশিবির বিশ্বদরবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ছাত্রসংগঠন। তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, জর্ডান, সৌদি আরব, সুদানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে ইসলামী ছাত্রশিবির দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা পালন করে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ছাত্রশিবিরের রয়েছে বলিষ্ঠ ভূমিকা। আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ছাত্রশিবির সত্য ও ন্যায়ের নীতি ধারণ করে মজলুমের পক্ষ নিয়েছে এবং অন্যায় ও অবিচারের ব্যাপারে শিবির থেকেছে প্রতিবাদমুখর। ১৯৭৯ সালে রাশিয়া তার পুতুল সরকার বারবাক কারমালের সহযোগিতায় স্বাধীনচেতা আফগান মানুষের স্বাধিকার কেড়ে নিয়ে সেখানে নগ্ন হামলা চালালে ছাত্রশিবির ঢাকায় ২০ হাজার তরুণের বিশাল মিছিল করে তার প্রতিবাদ জানায়। ছাত্রশিবির ফিলিস্তিনি বীর যোদ্ধাদের প্রতি সর্বদা সহানুভূতি প্রকাশ করে এসেছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আয়োজিত ১৯৯১-এর তেহরান কনফারেন্স- এ শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি যোগদান করেন। আন্দোলন, সংগ্রাম ও পুনর্গঠনে শিবির ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে সমর্থন ও সহমর্মিতা ব্যক্ত করেছে। কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, জাতিসংঘ প্রস্তাবিত গণভোট ও অন্যান্য প্রসঙ্গে শিবির বরাবরই কাশ্মিরি জনগণের পক্ষ নিয়েছে। অধিকৃত কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে শিবির ১৯৮৯ সাল থেকেই কর্মসূচি দিয়ে আসছে। বসনিয়া হার্জেগোভিনায় মুসলিম জনপদের ওপর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ ও দমন নীতির প্রতিবাদে শিবির আয়োজন করে র্যালি, সমাবেশ ও প্রতিবাদ সভা। সার্ব শাসক ও সেনাগোষ্ঠীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি ছিল এসব কর্মসূচির লক্ষ্য। ১৯৯১ সালে ইরাকের কুয়েত আক্রমণের ব্যাপারে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম প্রতিবাদকারী ছাত্রসংগঠন ছিল বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। পরবর্তীতে আফগানিস্তানে ও ইরাকে বৃহৎশক্তির নির্লজ্জ হামলা, সাধারণ মানুষকে হত্যা করা, শিশুদের নির্বিচারে খুন করার প্রতিবাদে শিবির ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। জনমত তৈরি, মিছিল, সমাবেশ, পোস্টারিংসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে কাপুরুষোচিত হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে সেখানকার নিহতদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে। ভারতের অযোধ্যায় অবস্থিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে (১৯৯১) উগ্রবাদী হিন্দুরা সে স্থানে রামমন্দির নির্মাণের অন্যায় আবদার করলে শিবির তার তীব্র প্রতিবাদ জানায় ও ব্যাপক জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখে। একইভাবে আহমেদাবাদে দাঙ্গা সৃষ্টি ও নির্বিচারে মুসলিম নিধনের প্রতিবাদ করে শিবির। সর্বশেষ সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী ও সহিংস বৌদ্ধদের নির্মম নির্যাতনের বিরুদ্ধেও ছাত্রশিবির ছিল প্রতিবাদমুখর। এভাবেই শিবির প্রতিটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দেশের সচেতন তরুণদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছে।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সমূহে ছাত্রশিবির অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির জন্মের পর থেকে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। ১৯৮২ সালে পর্যন্ত শিবিরকে জাতীয়তাবাদী দলের জাতীয় স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপসমূহের প্রতিবাদ করতে হয়েছে। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এরশাদ সরকারের স্বৈরশাসনবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে শিবির ছিলো অন্যদের সাথে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনরত, ১৯৯০-৯১তে এরশাদ স্বৈরশানের বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে অন্যদের সাথে শিবিরও ছিলো সে আন্দোলনের অন্যতম শরিক। ১৯৯১-র গণঅভ্যুত্থানের ফলে গণতান্ত্রিক পটপরিবর্তনের পর আবারও শিবিরকে রাজপথে নামতে হয়েছে জাতীয়তাবাদী দলের স্বৈরাচারী ভূমিকার বিরুদ্ধে। ১৯৯৬-এর পটপরিবর্তন পর আওয়ামী দুঃশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে আন্দোলন চলছে এখানেও শিবিরের ভূমিকা সক্রিয়। জাতীয় ইস্যু-সমূহের নামে উল্লেখযোগ্য ছিলো বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ধর্মদ্রোহিতার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি, কুদরত-এ-খোদা সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতাসহ ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০০৬ সালে আওয়ামী একদলীয় স্বৈরাচারে রূপ নিলে দেশের অন্যসব ছাত্রসংগঠনসহ শিবির গড়ে তুলে “সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য”। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আওয়ামী দুঃশাসন, জুলুম, নির্যাতন হত্যা, খুন, গুম ইত্যাদির মধ্য দিয়েও শিবির ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখে।
আদর্শবাদী দল পাহাড়সম ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারেও স্বীয় আদর্শের ভিত্তির ওপর টিকে থাকতে পারলে এর যাত্রাকে যারা অবরুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালায় তাদের অপচেষ্টা সময়ের পরিক্রমায় ভুল প্রমাণিত হয়। আদর্শবাদী দল ষড়যন্ত্র, নির্মম নির্যাতন ও ঘৃণ্য অপপ্রচারে সাময়িক অসুবিধায় থাকলেও চূড়ান্তভাবে এর যাত্রা অব্যাহত থাকে মঞ্জিলের দিকে। ছাত্রশিবিরকে তার যাত্রাপথে এ পর্যন্ত হাজারও বাধা মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়েছে। ছাত্রশিবিরের পথপরিক্রমায় নানামুখী ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র, জুলুম নির্যাতন ও অপপ্রচার অন্যতম। ছাত্রশিবির দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আদর্শিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে দেশের জনপ্রিয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে চলছিল ঠিক তখনই আদর্শিক লড়াইয়ে পরাজিতরা ঘৃণ্য পথে শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর নানামুখী নির্যাতন চালিয়ে তাদের বুলন্দ আওয়াজকে স্তিমিত করতে চায়।
যখন খুন, গুম ও নির্যাতন করে এর গতি পথ শ্লথ করা যাচ্ছে না ঠিক তখন অপপ্রচারকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে অবলম্বন করে নিয়েছে পরাজিতরা। শিবিরকে বলা হয়েছে চেতনায় রাজাকার, রগকাটা, মৌলবাদী, অনাধুনিক ও স্বাধীনতাবিরোধী, সন্ত্রাসী, নাশকতাকারী ইত্যাদি! এসব অপপ্রচার চালাতে গণমাধ্যম ও প্রশাসনকে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করেছে সরকার ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। ছাত্রশিবিরের দুর্দমনীয় উত্থানে ভীত হয়ে ছাত্রশিবিরের নিরপরাধ নেতাকর্মীদেরকে নাশকতার অভিযোগে অহরহ গ্রেফতার করে বোমা নাটক, অস্ত্র উদ্ধার নাটক সাজানো হয়েছে, যা ইতিহাসের এক জঘন্যতম মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। এমন অপপ্রচার অভিযুক্ত দলের পক্ষে প্রচারের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কারণ এমন ঘটনা যখন সাজানো হয় তখন ভুক্তভোগীদের আদর্শিক দৃঢ়তা আরও বেড়ে যায়, তারা তাদের যাত্রাপথে এগিয়ে যেতে আরও তীব্র শক্তি অনুভব করে। যারা এমন হটটক নিউজ পায় তারা উৎসুকের সাথে এমন খবরের আসল সত্য জানতে চেষ্টা করে, এক্ষেত্রে যুবকরাই উৎসুক হয়ে থাকে বেশি। শিবিরের বিরুদ্ধে প্রচারিত ঘৃণ্য ঘটনার অন্তরালে ডুবে আসল সত্য জানতে গিয়ে উৎসুকরা নিজেরা ছাত্রশিবিরের সমর্থক হয়ে যায়, তারা বুঝতে পারে এমন অসত্য প্রচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আর যারা অসত্য ঘটনাকে রঙ রস মিশিয়ে প্রচার করার কাজে ব্যস্ত তারাও জানে এটি মিথ্যা, এ কাজ করা তাদের জন্য ঠিক নয়। কিন্তু তাদের বিবেকবোধ লোপ পেয়েছে, তাই তারা মিথ্যাকে সত্যের প্রলেপে প্রচার চালাতে মোটেও দ্বিধা বোধ করে না।
এসব মিথ্যা অভিযোগে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা মোকদ্দমায় ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে জেলে পুরেছে। সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ এবং দেলোয়ার হোসাইনসহ মজলুম অনেক জনশক্তিকে দীর্ঘ দিন ধরে জেলখানায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। শহীদ করা হয়েছে সংগঠনের প্রথম দুই কেন্দ্রীয় সভাপতি মীর কাসেম আলী ও কামারুজ্জামানসহ শত শত নেতাকর্মীকে। ছাত্রশিবির কর্মীদেরকে গ্রেফতার করতে গিয়ে অসংখ্য সন্দেহভাজন সাধারণ ছাত্রকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা কখনই ছাত্রশিবিরের সাথে যুক্ত ছিল না। তারা মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করে। সময়ের ব্যবধানে ভিন্নমতের ছাত্ররাও ছাত্রশিবির সম্পর্কে অবগত হয় এবং অনেকে শিবিরে যোগ দিতেও দেখা গেছে। আলহামদুলিল্লাহ! ছাত্রশিবিরের ব্যাপারে যে সকল অভিযোগ এনেছে, প্রতিপক্ষরা অপপ্রচার করেছে তা বারবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
ছাত্রশিবিরের দৃঢ়প্রত্যয়ী পথপরিক্রমায় সরকার ও ইসলামবিদ্বেষীদের নির্মম আঘাতে শহীদ হয়েছেন ছাত্রশিবিরের অগনিত তাজা প্রাণ। যারা ছিল তাদের পরিবার, সহপাঠী, শিক্ষক ও প্রতিবেশীদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। মিথ্যার কাছে পরাস্ত হতে এরা শিখেনি। এমন দৃঢ়পদে পথ চলতে গিয়ে শত শত তরুণ পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। কারও পা নেই, কারও হাত নেই, কারওবা নেই চোখ। কেউ কেউ হারিয়েছেন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। যারা হক-বাতিলের লড়াইয়ে জীবন্ত সাক্ষী। যারা আমৃত্যু সামনে এগিয়ে যেতে সাহস জোগাবে এ পথের যাত্রীদেরকে- তারা এই কাফেলার জীবন্ত শহীদ।
যেখানে মজলুমানের শরীরের রক্তে রাজপথ, ক্যাম্পাস, জনপদ রঞ্জিত হয়েছে সেখান থেকেই নারায়ে তাকবিরের আওয়াজ বুলন্দ হয়েছে। যারা ছাত্রশিবিরকে নিঃশেষ করতে চেয়েছে তারাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মজলুমদের পক্ষে লাখো বনিআদম তাদের জীবনসম্পদ স্বপ্ন-সাধ বিলিয়ে দেয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। এটি আল্লাহর অশেষ করুণা ছাড়া আর কিছু নয়। সে কারণেই আল্লাহর অশেষ রহমতে ইসলামী ছাত্রশিবির ৪০ বছরের পথপরিক্রমায় নিজের অবস্থান করেছে সুসংহত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গন্ডি পেরিয়ে শহর, নগর, বন্দর পেরিয়ে এখন এর অবস্থান পাড়া-মহল্লার ঘরে ঘরে। আগামীর সম্ভাবনাময়ী তরুণ সমাজকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ছাত্রশিবির প্রতিটি জনপদে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে । ঘুণে ধরা সমাজে দিগভ্রান্ত যুবকদের পথের সন্ধান দিতে ছাত্রশিবির একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর ভ’মিকা পালন করছে। দুনিয়ার দক্ষতার পাশাপাশি অহির জ্ঞানে আলোকিত মানুষ হিসেবে তৈরি করাই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যতম কাজ। মাদকাসক্ত, নৈতিক অবক্ষয়সহ নানা অপরাধে জড়িত যুবকদের মাঝে সাহস, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার দৃঢ়তা নিয়ে তৈরিতে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা আপন বন্ধু হিসেবে কাজ করার অতুলনীয় মানসিকতা সত্যিই প্রশংসনীয়। এমন কাফেলার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে যারা সিদ্ধহস্ত তারা মূলত নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারে। কারণ তাদের ভালো কাজে অসহযোগিতার কারণে আগামী প্রজন্ম মরীচিকা সঙ্কুল চোরাপথে সত্য পথ খুঁজে না পেয়ে ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করে যা ধ্বংসের, অপ্রত্যাশিত।
ইসলামী ছাত্রশিবির একটি সুশৃঙ্খল ছাত্রসংগঠনের নাম। এ সংগঠন একজন ছাত্রকে যেভাবে ব্যক্তিগতভাবে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব গঠন করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে ঠিক সংগঠনের প্রতিটি পর্যায়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কর্মীগঠন, নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আদর্শ সংগঠন পরিচালনা পদ্ধতি শিক্ষণ কর্মসূচিগুলো একটি আদর্শ সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইসলামী ছাত্রশিবির তার সর্বস্তরের জনশক্তিকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, আলহামদুলিল্লাহ!
ইসলামী ছাত্রশিবির এখন দেশের সবচেয়ে সুশৃঙ্খল ও বৃহৎ সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে এই সংগঠনে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্ব নির্বাচনে নেই কোনো আন্তঃকোন্দল, দলাদলি, মারামারি। যারা নেতৃত্বের জন্য লোভাতুর তারা এ সংগঠনে নেতৃত্বের জন্য অনুপযুক্ত। যেখানে এসব ঘটনা অন্য ছাত্রসংগঠনের মাঝে ঘটছে অহরহ। তাই দেশে-বিদেশে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিয়ে বিবেকবান ব্যক্তিবর্গের কাছে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। তাদের স্বপ্ন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সৎ, দক্ষ তরুণরাই আগামীতে দেশ-জাতির নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে তার প্রত্যাশিত মঞ্জিলে উন্নীত করতে সক্ষম হবে। আর ছাত্রশিবিরের এই কাফেলা থেকে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলোর শেখার আছে অনেক কিছু। ছাত্রশিবির আজ হলফ করে বলতে পারে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা পরিবার ও সমাজের বোঝা হবে না ইনশাআল্লাহ। তারা মাদকমুক্ত, ইভটিজিংমুক্ত, মা-বোনদের সম্ভ্রম রক্ষাকারী, অনন্য পরোপকারী, সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজ মুক্ত।
বহুমুখী সন্ত্রাসের শিকার ইসলামী ছাত্রশিবির। প্রতিটি সরকার তাদের ইসলামবিদ্বেষী চেতনা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে বারবার আঘাত করেছে ছাত্রসংগঠনটির ওপর। ইসলামবিদ্বেষী দলগুলো আদর্শিক লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে অপপ্রচার, গুম, খুন ও জুলুম নির্যাতনকে পুঁজি করে এর যাত্রাকে নিঃশেষ করতে মরিয়া হয়ে লড়াই করছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষের চেতনাবোধ ইসলামের পক্ষে থাকলেও গুটিকয়েক আবু লাহাবের ষড়যন্ত্রে সকল প্রচারমাধ্যম ও সরকার সম্মিলিতভাবে দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘৃণ্য সম্মিলিত হামলার ভয়াবহ অক্টোপাসে আবদ্ধ হয়ে সত্য-মিথ্যার আসল স্বরূপ নিরূপণ করা আমজনতার জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রশিবির এমন বৈরী হাওয়ায় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল ও সমাজব্যবস্থার প্রকৃত স্বরূপ নিশ্চিত করার প্রয়াসে এক বুক আশা নিয়ে নির্ঘুম পথ চলছে। দেশকে যখন ফেইলস্টেট, তলাবিহীনঝুড়ি, মাঝিবিহীন তরী ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে উন্নত দেশের কর্তাব্যক্তিরা আক্ষেপ করেন, আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরাও হীনমন্যতায় ভোগেন, তখন ছাত্রশিবির বলতে পারে, এমন নিরাশার করালগ্রাস থেকে উম্মাহকে রক্ষার তাগিদে কিছু সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ছাত্রশিবির। যারা দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়ার কাছে পরাস্ত হওয়ার নয়, বরং দুনিয়া তাদের কাছে পরাস্ত হবে ইনশাআল্লাহ। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে ধরে সম্মুখে এগিয়ে চলছে। এই কাফেলার কর্মীরা তাদের চাকরি, ব্যবসা ও বিভিন্ন পেশায় সততা ও কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। নিজেকে সৎ, দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার এমন কাজটি একজন মুমিনের জন্য কৃত্রিম কোনো বিষয় নয় বরং এটি তার অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব। দক্ষতা অর্জন, কর্মনিষ্ঠ হওয়া এসব শারীরিকভাবে সুস্থ মুমিনের জীবনের অন্যতম গুণাবলি বলেই রাসূল সা: তার সাহাবীদের নসিহত করেছেন ঠিক সেভাবেই এগিয়ে যাওয়ার জন্য, যাত্রাকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য হিতাকাক্সক্ষীদের যৌক্তিক দিকনির্দেশনা দেয়ার পথ খোলা রেখেছে ছাত্রশিবির।
ইসলামী ছাত্রশিবির ৪০ বছরের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে একটি সোনালি অধ্যায় রচনা করেছে । একটি আদর্শিক ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রসমাজ ও আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে । সত্য ও সুন্দরের পক্ষে জীবন উৎসর্গ করেছে তার নেতাকর্মীরা। দুনিয়ার লোভ-লালসার কাছে তারা নিজেদের জলাঞ্জলি না দিয়ে পাহাড়সম বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যেতে তারা এখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা শুধুমাত্র দুনিয়ার ভোগের সাগরে নিজেদের ভাসিয়ে না দিয়ে দুনিয়াকে আখেরাতের পরীক্ষালয় হিসেবে গ্রহণ করে সকল রক্তচক্ষুকে মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। সরকার ও ইসলামবিদ্বেষীরা যদি বুঝতে সক্ষম হতো ইসলামী ছাত্রশিবিরের অন্তরালের অভাবনীয় দ্যুতিময় কল্যাণ ও সমৃদ্ধি, তাহলে তারা তাদের ঘৃণ্যতম পথ পরিহার করে এর পৃষ্ঠপোষণ করত। কিন্তু যারা অন্ধ, বধির, যারা ক্ষমতার স্পর্শে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য তাদের কাছে পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনই আসল জীবন। এরা পুঁজিবাদী ভোগের সাগরে ভাসতে পারলেই জীবনকে সফল ও সার্থক করা যায় বলে ধারণা করে। তাদের জন্য এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের চাইতে প্রিয় আর কী হতে পারে? তাই তারা পৃথিবীতে মৃত্যুশঙ্কায় মরার আগে বহুবার মরে। এককথায় এরা যেন জীবন্ত লাশ। তারা জীবনকে ভোগ করার চেষ্টা করলেও প্রকৃতপক্ষে এরা জীবনকে উপভোগ করতে পারে না। প্রকৃত উপভোগ্য জীবন হলো প্রশান্তিময় আত্মারজীবন, যা শুধু বস্তু দিয়ে উপভোগ করা যায় না।
ছাত্রশিবির যুবক, তরুণদের মাঝে ঘুণে ধরা সমাজ পরিবর্তনের একটি স্বপ্ন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ইতোমধ্যে। আজকের সমাজকে পরিবর্তন করে প্রত্যাশিত সোনালি সমাজ তৈরির জন্য প্রয়োজন সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব। যারা সমাজের সকল অন্ধকারকে পরিবর্তন করে উম্মাহকে মুক্ত করবে। ৪০ বছরের যাত্রাভিযানে ইসলামী ছাত্রশিবির এ জাতিকে উপহার দিয়েছে একদল সৎ, যোগ্য, মেধাবী, দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব। শিবির পরিণত হয়েছে তৌহিদী ছাত্র-জনতার আস্থা, কোটি মানুষের ভালোবাসা, স্বস্তি ও মুক্তির এক প্রিয় ঠিকানায়। শিবিরের এ অগ্রযাত্রা এবং জাতির প্রতি এর ভূমিকা আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। ছাত্রশিবিরের এ পথচলা আল্লাহ যেন কবুল করেন, তার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি। ছাত্রশিবির যেন প্রত্যাশিত মঞ্জিলে এগিয়ে যেতে পারে, সে তৌফিক আল্লাহর কাছে কামনা করছি।
আমাদের প্রত্যয় একটাই আল্লাহর পথে মোরা চলবোনিকষ কালিমা ভরা আকাশে ধ্রুব জ্যোতি তারা হয়ে জ্বলবো।